অর্থনীতিএনবিআরবিদেশবিশেষ সংবাদ

ইউএনএইচসিআর: ৪৬ গাড়িতে ৫০ কোটি অর্থদণ্ড, গাড়ি চালায় কে?

** গাড়ি দেয়া হয়েছে এসপি, ডিসি, শরণার্থী, রেড ক্রিসেন্ট অফিস, গণস্বাস্থ্য, উপজেলা হাসপাতালকে
** বিভাগীয় কার্যালয়, এনজিও ফোরাম, রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল, আডরা বাংলাদেশ, ব্র্যাক, অক্সফাম, আরটিএম
** গাড়ি ব্যবহার করেন দুযোর্গ ব্যবস্থাপনার বর্তমান সচিব ও বর্তমান শরণার্থী সেলের প্রধান, কোডেক

বিশেষ প্রতিনিধি: একটি, দুইটি নয়-ব্র্যান্ডের ৭৯ গাড়ি। প্রতিটি গাড়ির মূল্য কোটি টাকার বেশি। ‘অফিসিয়াল’ কাজে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয় এসব গাড়ি। শর্ত সাপেক্ষে খালাস হয় শুল্কমুক্ত সুবিধায়। গাড়ি নিজেদের কাজে একদিনের জন্যও ব্যবহার হয়নি। ছয় বছর ধরে এসব গাড়ি ব্যবহার করছে ১২টি সংস্থা ও তিনজন ব্যক্তি। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে গাড়ি হস্তান্তরে নেয়া হয়নি অনুমতি। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) এর বিরুদ্ধে শর্ত ভঙ্গ ও শুল্কমুক্ত সুবিধার এমন অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। ৭৯টি গাড়ির মধ্যে কেবল ৪৬টি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর ছিলো প্রায় ২৫ কোটি টাকা। আর শর্ত ভঙ্গ ও অপব্যবহার করায় ৪৬টি গাড়িতে ইউএনএইচসিআর-কে ৫০ কোটি টাকা অর্থ, ৯০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার এই অর্থদণ্ড ও জরিমানা করেছে। সম্প্রতি এই সংক্রান্ত বিচারাদেশ দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

অনুসন্ধান বলছে, গাড়ি ইউএনএইচসিআর আমদানি করলেও তারা এসব গাড়ি ব্যবহার করছে না। ২০১৮ সাল থেকে গাড়ি ব্যবহার করছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়, রেড ক্রিসেন্ট, গণস্বাস্থ্য, এনজিও ফোরাম, রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল, আডরা বাংলাদেশ, ব্র্যাক, অক্সফাম, কোডেক, আরটিএমসহ বিভিন্ন সংস্থা। দুযোর্গ ব্যবস্থাপনার বর্তমান সচিব ও বর্তমান শরণার্থী সেলের প্রধানও শুল্কমুক্ত সুবিধার গাড়ি ব্যবহার করে। সবচেয়ে বেশি ৩৯টি গাড়ি ব্যবহার করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)।

অপরদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনারের বিচারাদেশে বলা হয়েছে, এনবিআরের ১৯৭৫ সালের আদেশ অনুযায়ী অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য ইউএনএইচসিআর ঢাকা অফিস বিভিন্ন বিলাসবহুল জিপ, কার ও মাইক্রোবাস খালাস করা হয়। ২০১৮ সালের ৪ জুন ১৮টি ব্র্যান্ডনিউ টয়োটা ল্যান্ড কুসার প্রাডো, পাঁচটি হায়েস, ১৫টি পিকআপ, ১১ জুলাই চারটি ব্র্যান্ডনিউ ল্যান্ড কুসার অ্যাম্বুলেন্স, একটি ব্র্যান্ডনিউজ ল্যান্ড কুসার হার্ডটপ ডায়াসেল,২৬ আগস্ট তিনটি ট্রাকসহ মোট ৪৬টি গাড়ি খালাস নেয়। এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, ‘শুধুমাত্র ইউএনএইচসিআর এর অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে। আর সেই শর্তে গাড়ি খালাস নেয়া হয়।’

আরো বলা হয়, গাড়ি নিজেরা ব্যবহার না করে অন্যদের হস্তান্তর করতে হলে এনবিআরের ২০০০ সালের আদেশ অনুযায়ী এনবিআর থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু ইউএনএইচসিআর সে অনুযায়ী নেয়নি। অনুমতি না নিয়েই গাড়িগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে। এনবিআরের ১৯৭৫ ও ২০০০ সালের দুইটি আদেশ সুস্পষ্ট লঙ্গন করেছে। যার ফলে এসব গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। শুল্ককর পরিশোধ ও ব্যাখ্যা দিতে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ইউএনএইচসিআর থেকে চিঠির মাধ্যমে বলা হয়, ৪৬টি গাড়ির মধ্যে সাতটি গাড়ি ইউএনএইচসিআর এখন ব্যবহার করছে। বাকি ৩৯টি গাড়ি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও এনজিও ব্যবহার করছে (৩২টি শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় বা আরআরআরসি, চারটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট ও তিনটি অ্যাম্বুলেন্স গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র)। চুক্তির মাধ্যমে তাদের এসব গাড়ি দেয়া হয়েছে। গাড়ির কোন ধরনের অপব্যবহার হলে এর জন্য তারা দায় থাকবে এবং ইউএনএইচসিআর গাড়ি ফেরত নিতে পারবে। তবে গাড়ি হস্তান্তরে কোন অনুমতি এনবিআর থেকে নেয়া হয়নি। অনুমতি ছাড়াই বিভিন্ন সংস্থার কাছে হস্তান্তর করেছে।

বলা হয়, ২১ নভেম্বর ব্যক্তিগত শুনানিতে অংশ নিতে ইউএনএইচসিআর-কে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু তাদের কোন প্রতিনিধি অংশ নেয়নি। ফলে শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার ও এনবিআরের আদেশ লংঘন করায় ২১ ডিসেম্বর কাগজপত্র ও লিখিত জবাব পর্যালোচনা করা হয়। আদেশ লংঘন করায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী ৪৬টি গাড়িতে ইউএনএইচসিআর-কে ৫০ কোটি ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড ও ৯০ লাখ টাকা বিমোচন জরিমানার আদেশ দেন কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান। ৪৬টি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর ২৫ কোটি ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩০ টাকা। অর্থদণ্ড, জরিমানা ও প্রযোজ্য শুল্ককরসহ মোট ৭৬ কোটি ২ লাখ ৮৮ হাজার ৩০ টাকা পরিশোধে ইউএনএইচসিআর-কে ৩০ দিনের সময় দেয়া হয়।

এনবিআর সূত্রমতে, ইউএনএইচসিআর এর মতো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা নিয়ম না মেনে এবং অনুমতি না নিয়ে গাড়ি হস্তান্তর করায় হতবাক এনবিআর কর্মকর্তারা। ৭৯টি গাড়ি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে এনবিআর। প্রতিবেদন অনুযায়ী শুল্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করায় ব্যবস্থা নিতে ছয়টি কাস্টম হাউসকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইউএনএইচসিআর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরা ও পুর্নবাসনে কাজ করছে। নিজেদের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করে। ১৯৭৫ সালের এনবিআরের এক আদেশ অনুযায়ী এসব গাড়ি শর্ত সাপেক্ষে শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস দেয়া হয়। ২০০০ সালের এক আদেশ অনুযায়ী এসব গাড়ি হস্তান্তর বা বিক্রির ক্ষেত্রে এনবিআর থেকে লিখিত অনুমতি নেয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। ইউএনএইচসিআর অফিসিয়াল কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময় ১১৫টি গাড়ি আমদানি করে। এর মধ্যে ৩৬টি গাড়ি ইউএনএইচসিআর নিজেরা ব্যবহার করলেও ৭৯টি গাড়ি নিয়ম না মেনেই হস্তান্তর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই ভিত্তিতে এনবিআর ছয়টি কাস্টম হাউস (ঢাকা কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, বেনাপোল কাস্টম হাউস, আইসিডি কমলাপুর কাস্টম হাউস, মোংলা কাস্টম হাউস ও পানগাঁও কাস্টম হাউস), অ্যাসাইকুডা ও ইউএনএইচসিআর থেকে গাড়ি আমদানির তথ্য নেয়। যাতে দেখা যায়, এসব গাড়ি ইউএনএইচসিআর নিজেদের অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করছে না। এই নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ২৬ এপ্রিল কাস্টম হাউসগুলোকে পাঠায় এনবিআর।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭৯টি বিলাসবহুল গাড়ির মধ্যে ৭০টি জিপ, ছয়টি মাইক্রোবাস ও তিনটি ট্র্যাকার গাড়ি। এসব গাড়ি ব্যবহার করছেন ১২টি প্রতিষ্ঠান-সংস্থা, তিন ব্যক্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৭টি গাড়ি ব্যবহার করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় (আরআরআরসি)। এর মধ্যে একটি ২০০৯ মডেলের ৪১৬৪ সিসির ল্যান্ড কুসার স্টেশন ওয়াগন, একটি ২০১২ মডেলের ২৯৮৬ সিসির ল্যান্ড কুসার প্রাডো, ২০১৫ মডেলের ২৯৮৬ সিসির তিনটি প্রাডো, ২০১৫ মডেলের ২৯৮৬ সিসির একটি ও ২০১৬ মডেলের ২৯৮৬ সিসির দুইটি হায়েস, ২০১৭ মডেলের ২৪৯৪ সিসির দুইটি হিলাক্স ডিসি, ২০১৭ মডেলের ২৯৮৬ সিসির চারটি প্রাডো, ২০১৭ মডেলের ২৯৮৬ সিসির তিনটি হিলাক্স ডিসি, ২০১৭ মডেলের ৪১৬৪ সিসির একটি ল্যান্ড কুসার, ২০১৮ মডেলের ১২৮৮০ সিসির একটি ট্র্যাকার, ২০১৮ মডেলের ২৪৮৮ সিসির সাতটি নাভারা, ২০১৮ মডেলের ২৯৮২ সিসির ১০টি প্রাডো, ২০১৮ মডেলের ৪১৬৪ সিসির দুইটি ল্যান্ড কুসার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাতটি গাড়ি ব্যবহার করে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়। ২০১৮ সালে এসপি অফিসকে এসব গাড়ি দেয়া হয়। একটি টয়োটা প্রাডো ব্যবহার করছে দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় (এমডিএমআর)। বর্তমানে গাড়িটি ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব ব্যবহার করেন। একটি টয়োটা প্রাডো ব্যবহার করে এমডিএমআর এর হেড অব রিফিউজি সেলের প্রধান (শরণার্থী সেল প্রধান)। কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস অফিস দুইটি নাভারা গাড়ি ব্যবহার করে। একটি প্রাডো গাড়ি কক্সবাজারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার অফিস, একই মডেল ও সিসির একটি গাড়ি কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, একটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, একটি টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ব্যবহার করে। একটি ল্যান্ড কুসার গাড়ি ব্যবহার করে কক্সবাজারের বাইতুশ শরফ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। একটি হিলাক্স ডিসি গাড়ি ব্যবহার করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থান কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক)।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র চারটি গাড়ি ব্যবহার করে। তিনটি গাড়ি ব্যবহার করে এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ। একটি ল্যান্ড কুসার ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনাল। আন্তর্জাতিক সংস্থা সোলিডারিটিজ ইন্টারন্যাশল একটি হিলাক্স ডিসি গাড়ি ব্যবহার করে। একশান সেন্টার একটি হিলাক্স ডিসি ব্যবহার করে। আডরা বাংলাদেশ একটি হিলাক্স ডিসি ও একটি হায়েস গাড়ি ব্যবহার করে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পাঁচটি গাড়ি ব্যবহার করে। একটি হিলাক্স ডিসি ও একটি ল্যান্ড কুসার ব্যবহার করে ব্র্যাক। একটি হিলাক্স ডিসি ও একটি ল্যান্ড কুসার ব্যবহার করে দাতব্য সংস্থা অক্সফাম বাংলাদেশ। টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ইনকরপোরেটেড একটি হিলাক্স ডিসি ও একটি ল্যান্ড কুসার ব্যবহার করে। রিসার্চ ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (আরটিএম) ইন্টার‌ন্যাশনাল একটি ল্যান্ড কুসার ব্যবহার করে।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইউএনএইচসিআর, ঢাকা কার্যালয়ের এসিস্টেন্ট কমিউনিকেশন অফিসার মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বক্তব্যের বিষয় ই-মেইল ও হোয়াসঅ্যাপে লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন তিনি। ই-মেইল ও হোয়াসঅ্যাপে বক্তব্য পাঠানো হলেও জবাব দেয়া হয়নি। পরে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইউএনএইচসিআরের মতো প্রতিষ্ঠান যারা শুদ্ধাচারের কথা বলে, তারা যদি নিজেদের কাজে ব্যবহার করবে বলে গাড়ি আমদানি করে আইন লঙ্ঘন করে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মনে করি কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ইউএনএইচসিআর সমানভাবে আইন পরিপালন করবে বলে আমরা আশা করি।’

###

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button