অর্থনীতিএনবিআরকর্পোরেটজাতীয়বিশেষ সংবাদ

মিথ্যা ঘোষণায় যন্ত্রাংশ আমদানি করে ‘টেকনো-ইনফিনিক্স’

** টেকনো ও ইনফিনিক্স ব্র্যান্ডের যন্ত্রাংশ আমদানিতে প্রায় দুই কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকির চেষ্টা হয়েছে
** কায়িক পরীক্ষায় এক যন্ত্রাংশের সঙ্গে একাধিক যন্ত্রাংশ যুক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে

বিশেষ প্রতিনিধি: মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ আমদানিতে সিপিসি (কাস্টমস প্রসিডিউর কোড) বা রেয়াতি সুবিধা দিয়েছে সরকার। শর্ত হলো-রেয়াতি সুবিধা নিতে হলে যন্ত্রাংশ বিযুক্ত অবস্থায় আমদানি করতে হবে। কিন্তু মোবাইল উৎপাদন বা সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে শর্ত মানছে না। যন্ত্রাংশ যুক্ত অবস্থায় আমদানি করা হচ্ছে। একটি যন্ত্রাংশের সঙ্গে একাধিক যন্ত্রাংশ যুক্ত অবস্থায় আমদানি করা হচ্ছে। একাধিক যন্ত্রাংশ যুক্ত অবস্থায় আমদানি করে খালাস নেয়া হয় একটি যন্ত্রাংশ বলে। যদিও প্রতিটি যন্ত্রাংশের আলাদা এইচএস কোড দেয়া আছে। মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে ও শর্ত ভঙ্গের মাধ্যমে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করে কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রাংশ আমদানি করে আসছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিডি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে আইটেল ও টেকনো ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন বাজারজাত করে আসছে। কার্লকেয়ার টেকনোলজির দুইটি চালানে মিথ্যা ঘোষণা প্রমাণিত হওয়ায় জরিমানা ও অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। ঢাকা কাস্টম হাউস পৃথক দুইটি মামলায় বিচারাদেশ দিয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, কার্লকেয়ার টেকনোলজি চলতি বছরের ৩১ মার্চ ‘ইনফিনিক্স’ ব্র্যান্ডের মোবাইল যন্ত্রাংশ আমদানি করে। ৪ এপ্রিল মেঘলা এন্টারপ্রাইজ সিএন্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে পণ্য খালাসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। মিথ্যা ঘোষণায় তথ্য থাকায় কাস্টমস গোয়েন্দার তথ্যের ভিত্তিতে চালানটির খালাস স্থগিত করে ঢাকা কাস্টম হাউস। পরে সিএন্ডএফ এজেন্টের উপস্থিতিতে চালানটি শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। যাতে লিকুইড ক্রিস্টাল মডিউল ঘোষণা দেয়া হলেও কায়িক পরীক্ষায় লিকুইড ক্রিস্টাল মডিউল ফিটেট এফ পি সি, মেটাল অ্যাডহেসিভ ক্যাসিং, ডাবল গ্লু অ্যাডহেসিভ ট্যাপ, কনডাক্টিং ফেব্রিক, সিঙ্গেল ফরম ট্যাপ এন্ড অ্যাডহেসিভ টাইপ ফোম পাওয়া যায়। ক্যামেরা মডিউল ঘোষণা দেয়া হলেও ক্যামেরা ফিটেড এফ পি সি এবং টাচ প্যানেল, ডেকোরেশন স্টিল শিট ফর মেলিং মোবাইল বডি কাস্টিং ঘোষণা হলেও প্রিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর ফিটেড এফ পি সি, প্লাস্টিক ব্র্যাকেট ফিটেড ফ্লাশ এফ পি সি পাওয় যায়। বিল অব এন্ট্রিতে এইচএস কোড-৮৫২৪৯৯০০ ও ৮৫১৭৭৯০০ ঘোষণায় দিয়ে সকল ক্ষেত্রে সিপিসি এ৬৭ ব্যবহার করে রেয়াতি সুবিধায় পণ্য খালাসের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু একাধিক যন্ত্রাংশ যুক্ত অবস্থায় থাকায় এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে। যাতে রেয়াতি সুবিধা প্রাপ্য হবে না। আমদানি করা এই চালানে পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ২ কোটি ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৩৯১ টাকা। যাতে ফাঁকি দেয়া শুল্ককর ৩৩ লাখ ৭২ হাজার ৪০২ টাকা। এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ করে শুল্ককর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা প্রমাণিত হয়। এতে প্রতিষ্ঠানকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানকে ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে সম্প্রতি বিচারাদেশ দেয় ঢাকা কাস্টম হাউস কমিশনার। জরিমানা ও অর্থদণ্ডসহ মোট এক কোটি ৮ লাখ ৭২ হাজার ৪০২ টাকা শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়।

অপরদিকে, একই আমদানিকারক ৩ এপ্রিল টেকনো ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ আমদানি করে। ৪ এপ্রিল মেঘলা এন্টারপ্রাইজ সিএন্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। মিথ্যা ঘোষণার তথ্য থাকায় আবারো কাস্টমস গোয়েন্দার তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা কাস্টম হাউস চালানটির খালাস স্থগিত করে। পরে সিএন্ডএফ এজেন্টের উপস্থিতি শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে। যাতে এক যন্ত্রাংশের সঙ্গে একাধিক যন্ত্রাংশ বিযুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এতে প্রতিষ্ঠানটি একদিকে মিথ্যা ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করে। আমদানি করা পণ্যের মূল্য ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৬৭ হাজার ৩৫৪ টাকা। যাতে ফাঁকি দেয়া শুল্ককর ৩৩ লাখ ১ হাজার ৮৫১ টাকা। এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ ও রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৬৭ লাখ টাকা জরিমানা ও ৩ লাখ অর্থদণ্ড দিয়ে বিচারাদেশ জারি করে ঢাকা কাস্টম হাউস। জরিমানা ও অর্থদণ্ডসহ মোট এক কোটি ৩ লাখ ১ হাজার ৮৫১ টাকা শুল্ককর পরিশোধে প্রতিষ্ঠানকে ১৫ দিনের সময় দেয়া হয়।

অপরদিকে, কার্লকেয়ার দীর্ঘদিন দীর্ঘদিন ধরে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করার বিষয়টি অস্বীকার করেন সিএন্ডএফ এজেন্ট মেঘলা এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে নয়, মাঝে মাঝে কিছু চালান আমদানি হয়েছে। মিথ্যা ঘোষণা দেয়া হতো না। কোম্পানি এলসি করে, ইনভয়েস করে। আমরা তো আর এলসি করি না। আমরা মিথ্যা ঘোষণা দেবো কেন।’

অন্যদিকে, মিথ্যা ঘোষণার বিষয়ে কার্লকেয়ার টেকনোলজি বিডি লিমিটেড (আইটেল ও টেকনো) এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘সিপিসি ডিক্লারেশন নিয়ে কিছুদিন আগে বেশ কিছু প্রোবলেম ধরা পড়েছিল। এজন্য অনেকদিন থেকে আমাদের সবার প্রোডাক্ট ক্লিয়ারিং করা সমস্যা হয়ে গিয়েছিল। এখানে যে এইচএস কোড দেয়া আছে, তাতে বুঝার প্রোবলেম হয়েছে। এখন যে এসআরও এসেছে, তাতে অনেক কিছু কাভার হয়ে গেছে। এরপর মনে হয় না কোন মিস কমিউনিকেশন বা ভুল বুঝাবুঝি থাকবে।’ এসআরও এর শর্ত ভঙ্গ করে রেয়াতি সুবিধা নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডিক্লারেশনের যে জায়গা ছিলো, সেখানে কিছুটা মিস আন্ডাস্টান্ডিং হয়েছে। সিপিসিতে বলা হচ্ছে যে, এফ পি সি ক্যাবল রেয়াতি সুবিধা পাবে। এফ পি সি ক্যাবল হচ্ছে কানেক্টর। এটা ক্যামেরা মডিউল, ফিঙ্গারফিন্টের সঙ্গে থাকতে পারে। ফিঙ্গারফিন্ট অথবা ক্যামেরা মডিউল একটা কম্পোনেন্ট। এই কম্পোনেন্টের সাথে একটা করে ক্যাবেল থাকতে পারে। না হলে সে কানেক্ট করবে কিভাবে? কাস্টমস গোয়েন্দা বলতেছে, এফ পি সি এর আলাদা এইচএস কোড আছে। মোবাইলের অনেক কম্পোনেন্ট আছে। ডিসপ্লে একটা কম্পোনেন্ট, ফিঙ্গারফিন্ট একটা কম্পোনেন্ট, পিসিবি একটা কম্পোনেন্ট, ক্যামেরা একটা কম্পোনেন্ট। ক্যামেরা এক জায়গায়, ফিঙ্গারফিন্ট এক জায়গায়, ডিসপ্লে এক জায়গায় প্রোডাক্টশন হয়েছে। অ্যাসেম্বলিং করার সময় এগুলো এফ পি সি ক্যাবেল দিয়ে কানেক্ট করা হচ্ছে। এফ পি সি ক্যাবেল প্রত্যেকটা কানেক্টরের সাথে থাকে। আবার আলাদা করেও আনতে হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, ডিসপ্লে এর সঙ্গে কেন এফ পি সি ক্যাবল আনা হয়। আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে, এফ পি সি ক্যাবল যদি না থাকে, আমি তো ডিসপ্লে প্রোডাক্টশন করি না, আরেকটা কোম্পানি প্রোডাক্টশন করে। ডিসপ্লে এর সঙ্গে এফ পি সি ক্যাবল কানেক্টিং করেই দেয়া থাকে। আমি শুধু মাদার বোডের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারি। শুরু থেকেই এসব কনফিউশন ছিলো।’

এনবিআর সূত্রমতে, দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর অংশ হিসেবে মোবাইল ফোনের কারখানা গড়ে তুলতে যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দেয়া হয়। ২০২১ সালের ২৪ মে একটি এসআরও জারি করে এনবিআর। তবে শর্ত দেয়া হয় যে বিযুক্ত অবস্থায় যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হবে। অভিযোগ উঠে যে, কোম্পানিগুলো একটি যন্ত্রাংশের ঘোষণা দিয়ে তার সঙ্গে একাধিক যন্ত্রাংশ যুক্ত করে ঘোষণা ছাড়াই খালাস নিচ্ছে। এতে একদিকে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে, অন্যদিকে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে। কোম্পানিগুলো প্রতিটি চালানে কোটি কোটি টাকা রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহার করছে। শুধুমাত্র এলসিএম এর সঙ্গে এফপিসি যুক্ত করায় এর মোট শুল্ককর দাঁড়ায় ৫৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। অভিযোগের ভিত্তিতে সম্প্রতি কাস্টমস গোয়েন্দা চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রায় ৩০টি চালান খালাস স্থগিত করে। ইতোমধ্যে কয়েকটির কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যাতে রেয়াতি সুবিধার অপব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে।

####

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button