মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে কার্যকর ৩০ শতাংশ শুল্কের সঙ্গে এটি যুক্ত হলে চীনা পণ্যের মোট শুল্কহার প্রায় ১৩০ শতাংশে পৌঁছাবে। নতুন এ শুল্ক আগামী ১ নভেম্বর বা তার আগেই কার্যকর হতে পারে। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) বিকেলে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে ট্রাম্প এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যের ওপর এখনকার তুলনায় আরও ১০০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবে। পাশাপাশি ১ নভেম্বর থেকে চীনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার আমদানির ক্ষেত্রেও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ জারি করা হবে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ—বিরল খনিজ রপ্তানিতে নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপ। আধুনিক ইলেকট্রনিকস, সেমিকন্ডাক্টর, সামরিক সরঞ্জামসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে এসব খনিজ অপরিহার্য। এই খাতে চীনের দীর্ঘদিনের একচ্ছত্র প্রভাব রয়েছে। ট্রাম্প মনে করেন, চীনের এই পদক্ষেপ মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার কৌশল। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায়, চলতি মাসের শেষে দক্ষিণ কোরিয়ায় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকটি ট্রাম্প বাতিল করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই বিশ্ব পুঁজিবাজারে তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কা করছেন, গত বছর চীনা পণ্যে শুল্কহার যখন সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশে পৌঁছেছিল, তখনকার মতো সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি আবার ফিরে আসতে পারে। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। শুক্রবার বাজার বন্ধের সময় বড় ধরনের দরপতন ঘটে—ডাও জোনস সূচক ৮৭৮ পয়েন্ট বা ১.৯ শতাংশ কমে যায়, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ২.৭ শতাংশ হ্রাস পায়, আর প্রযুক্তিনির্ভর নাসডাক সূচক ৩.৫ শতাংশ কমে বন্ধ হয়। বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পরস্পরের ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। যদিও সম্প্রতি মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য সরবরাহে চীনকে ছাড়িয়ে গেছে, তবু ইলেকট্রনিকস, পোশাক ও আসবাবপত্রসহ শত শত কোটি ডলারের চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা এখনও প্রবল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও চীনের অন্যতম বড় রপ্তানি বাজার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গত বছর চীনা পণ্যের ওপর শুল্কের হার ১৪৫ শতাংশে পৌঁছানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল। তখন ট্রাম্প প্রশাসন ইলেকট্রনিকস পণ্যের শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে এই অর্থনৈতিক চাপে সামঞ্জস্য আনতে চেষ্টা করেছিল। এই পদক্ষেপই মূলত প্রশাসনের স্বীকারোক্তি হিসেবে দেখা যেত যে, নিজেদের আরোপিত শুল্ক অর্থনীতিকে ব্যাহত করছে। পরে গত মে মাসে উভয় দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এক চুক্তিতে পৌঁছায়—চীন মার্কিন পণ্যের শুল্ক ১২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে কমায়, আর যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের শুল্ক ১৪৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনে। এই চুক্তি উভয় দেশের পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন সৃষ্টি করেছিল।
ট্রাম্প দাবি করেছেন যে চীনের বাণিজ্যিক প্রতিক্রিয়া ‘হঠাৎ’ শুরু হয়েছে, যদিও কয়েক মাস ধরে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। চুক্তি অনুযায়ী চীন বিরল খনিজের সরবরাহ বাড়াতে ব্যর্থ হওয়ায় ট্রাম্প একাধিকবার তাদের চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ করেছেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে এনভিডিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চিপসহ কিছু আমেরিকান প্রযুক্তি পণ্যের বিক্রি সীমিত করেছিল, যদিও পরে অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় তখন, যখন ট্রাম্প প্রশাসন ঘোষণা করে যে চীনা মালিকানাধীন বা পরিচালিত জাহাজে পরিবাহিত পণ্যের ওপর নতুন মাশুল আরোপ করা হবে। চীনও সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন জাহাজের ওপর সমমানের পাল্টা মাশুল আরোপ করেছে। তবে এই ধরনের শুল্ক আরোপের ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টে একটি ঐতিহাসিক মামলার রায়ের ওপর নির্ভর করছে, যা শিগগিরই ঘোষণা হতে পারে। আদালতের এই প্রক্রিয়া চলায় বাণিজ্যযুদ্ধের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।

