পশ্চিমা বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ফলে গত বছর বেশি সুতা আমদানি করেছে বাংলাদেশ, জানালেন স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা। ভারত থেকে সুতা আমদানির দিকে ঝুঁকেছে বাংলাদেশ, কারণ প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় তৈরি পোশাক বাজারে এগিয়ে থাকতে এবং সময়মতো রপ্তানি চালান সরবরাহ করতে এটি প্রয়োজন। এছাড়া, দেশের সুতার মিলগুলো অপর্যাপ্ত গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশ গত বছর ১২ লাখ ১৫ হাজার টন সুতা আমদানি করেছে, যা ২০২৩ সালের ৯ লাখ ২৪ হাজার টনের তুলনায় ৩১.৪৫% বেশি। এ তথ্য জানায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৩০০ কোটি ডলার, যার ৯৫ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে। এছাড়া গত বছরের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেক মিল বন্ধ হয়ে যায়।
স্থানীয় সুতা ও ভারত থেকে আমদানি করা সুতার মধ্যে প্রতি কেজিতে দামের পার্থক্য ২০ থেকে ২৫ সেন্ট। এতে পোশাক রপ্তানিকারকরা দেশে উৎপাদিত সুতার চেয়ে ভারত থেকে আমদানি করা সুতার ওপর বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন চৌধুরী বলেন, ‘দেশি সুতার চেয়ে আমদানি করা সুতার দাম কম। তাছাড়া দেশের সুতা খাত বেশ কয়েক বছর ধরে অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহে ভুগছে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশ বাড়ায়, এতে দেশে সুতার উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া গত বছরের রাজনৈতিক ও শ্রমিক অস্থিরতার কারণে মিল মালিকরা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কারখানা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিল।’
তিনি মন্তব্য করেন,বাংলাদেশ সরকার টেক্সটাইল ও পোশাকের ওপর প্রণোদনা কমানোর ফলে সুতা উৎপাদন প্রভাবিত হয়েছে, যেখানে ভারত সরকার এসব ব্যবসায়ীদের জন্য নগদ প্রণোদনা বাড়িয়েছে, ফলে তারা কম দামে সুতা সরবরাহ করতে পারে। উৎপাদন খরচ ব্যবসায়ীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বাংলাদেশে সুতার চাহিদা বাড়ছে বলে অনেক ভারতীয় ব্যবসায়ী ইতোমধ্যে ইন্দো-বাংলা স্থলবন্দরের কাছে ওয়্যারহাউস খুলেছেন। যেন তারা দ্রুত সময়ে পর্যাপ্ত সুতা সরবরাহ করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত সরকার টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্পে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে এবং তাদের রপ্তানিকারকরা ভালো করছেন। তাই ভারতীয় মিলাররা অনেক কম দামে সুতা সরবরাহ করতে পারে।’
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশে সুতা আমদানি বেড়েছে মূলত চারটি কারণে। প্রথমত, গত বছর সরকার দেশি সুতার নগদ প্রণোদনা চার শতাংশ থেকে কমিয়ে এক দশমিক পাঁচ শতাংশ করেছে, যা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ ছিল।
তিনি বলেন, ফলে স্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সুতা আমদানি করতে শুরু করে। কারণ দামের পার্থক্য কেজিপ্রতি ২০-২৫ সেন্ট। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়ায় বাংলাদেশে পর্যাপ্ত সুতার প্রয়োজন। তবে দেশীয় মিলাররা পর্যাপ্ত পরিমাণে ও সময়মতো প্রয়োজনীয় সুতা সরবরাহ করতে পারছেন না। সাধারণত চীন ও ভারত এ ধরনের সুতার প্রধান উত্পাদক ও সরবরাহকারী।
তৃতীয়ত, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ও আন্তর্জাতিক পোশাক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে আরও ভালো দাম পেতে দেশে মানবসৃষ্ট ফাইবারের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশে এখনো মানবসৃষ্ট ফাইবারের পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই এবং তাই এটি আমদানির জন্য ভারত ও চীনের উপর নির্ভর করতে হয়। তিনি আরও বলেন, দেশে মানবসৃষ্ট সুতার সঙ্গে চীনা নন-কটন সুতার দামের ব্যবধান কেজিপ্রতি ৫০-৬০ সেন্ট। এবং সর্বশেষ তিনি বলেন, সব ধরনের সুতার জন্য দাম একটি বড় বিষয়, কারণ ভারত অনেক কম দামে পর্যাপ্ত এবং দ্রুত সুতা সরবরাহ করতে পারে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশে সুতার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভারত থেকে অবৈধভাবে সুতা পাচার হচ্ছে। তিনি সরকারের কাছে প্রাথমিক বস্ত্র খাতে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নীতি সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।