** বাংলাদেশ নতুন বলে আমদানি করা পুরাতন বিলাসবহুল গাড়ির মধ্যে রয়েছে রোলস রয়েস, বেন্টলি, ফেরারি, মাসেরাতি, পোরশে, রেঞ্জ রোভার, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ
** বিলাসবহুল এসব গাড়ির যুক্তরাজ্যের নিবন্ধন রয়েছে, কিন্তু নতুন বলে বাংলাদেশে আমদানি করা হলেও এসব গাড়ি বাংলাদেশে রপ্তানির কোনো তথ্য যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে নেই বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে
** ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি করা ৪৩১টি গাড়ির তথ্য যাচাই করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২৮টি গাড়ির বাংলাদেশে রপ্তানির কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, ২১৬টি গাড়ির রপ্তানি-ই হয়নি, মাত্র ৮৭টি বাংলাদেশে রপ্তানি হয়েছে
** নতুন বলে আমদানি করা ১৭টি পুরাতন গাড়ির তথ্য যাচাই করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা, যাতে রাজস্ব ফাঁকি পেয়েছে প্রায় ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা
** অটো মিউজিয়াম, এএএ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পোর্ট, এশিয়ান ইম্পোর্টস লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল মটরস, অটো ইম্পোর্টস লিমিটেড, অভি ট্রেডিং, টিবিএইচ কোং ব্র্যান্ডনিউ বিলাসবহুল গাড়ির নামে পুরাতন গাড়ি আমদানি করেছে
‘ব্র্যান্ডনিউ’ ঘোষণায় বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে বিশ্বখ্যাত সব বিলাসবহুল গাড়ি। তালিকায় রয়েছে রোলস রয়েস, বেন্টলি, ফেরারি, মাসেরাতি, পোরশে, রেঞ্জ রোভার, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজের মতো গাড়ি। গাড়ির উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ‘ইউরোপীয় অরিজিন’। অথচ ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণার এসব গাড়ি হচ্ছে পুরাতন। অর্থাৎ এসব গাড়ি যুক্তরাজ্যে ব্যবহার হয়েছে। সেখানে এসব গাড়ির নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে নিবন্ধন থাকা গাড়ি বাংলাদেশে রপ্তানি হচ্ছে, সেই রপ্তানির রেকর্ডও যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। অনুসন্ধান বলছে, মাত্র চার বছর দুই মাসে বাংলাদেশে ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণায় এমন ৪৩১টি গাড়ি যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি হয়েছে। পুরাতন বা ব্যবহৃত এসব গাড়ি আমদানি নীতি আদেশ লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ‘ব্র্যান্ডনিউ’ ঘোষণায় বাংলাদেশে আমদানি করা হয়েছে। প্রতিটি গাড়িতে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এসব গাড়ি কোন অনুমোদিত ডিলার নয়, বাংলাদেশের এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক কাগজপত্র জালিয়াতি করে আমদানি করেছেন। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে এই সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব গাড়ির অধিকাংশই এখন গ্রাহক পর্যায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেসব গাড়ি পূর্বে নিবন্ধনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে (ঘোষণা ব্র্যান্ডনিউ, প্রকৃতপক্ষে পুরাতন), সেসব গাড়ি জব্দ করা বা পরবর্তী অন্য কি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়ে নির্দেশনা চেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। তবে, এসব গাড়ি খালাসের ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাগজপত্র যাচাই না করায় এবং রাজস্ব ফাঁকিতে সহায়তা করায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দায় দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ‘ব্র্যান্ডনিউ’ ঘোষণায় ইউরোপীয় অরিজিনের ‘পুরাতন’ বিলাসবহুল গাড়ি বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে বলে তথ্য পায় কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এরই প্রেক্ষিতে এসব গাড়ি আমদানির বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা অনুসন্ধান পরিচালনা করে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনুমোদিত ডিলার ব্যতীত অন্যান্য আমদানিকারকরা যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিলাসবহুল আমদানি করেছে ও করছে। যার মধ্যে রয়েছে-রোলস রয়েস, বেন্টলি, ফেরারি, মাসেরাতি, পোরশে, রেঞ্জ রোভার, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ। অনুসন্ধান বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে এই ধরনের প্রায় ৪৩১টি গাড়ি আমদানি হয়েছে। ৪৩১টি গাড়ি যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি হয়েছে, সেই রপ্তানির তথ্য যাচাই করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ২১৬টি গাড়ি এখনো রপ্তানি হয়নি (কোন দেশে), ৮৭টি গাড়ি রপ্তানি হয়েছে, ১২৮টি গাড়ির রপ্তানির কোনো তথ্য রপ্তানিকারক দেশের কাছে নেই। অনেক গাড়ির মূল্য চার থেকে ১০ কোটি টাকারও বেশি।
কাস্টমস গোয়েন্দার প্রাথমিক অনুসন্ধান অনুযায়ী ১৭টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশি সাতটি গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এই ১৭টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেছে। ১৭টি আমদানিকারকের মধ্যে রয়েছে-অটো মিউজিয়াম লিমিটেড, এএএ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পোর্ট, এশিয়ান ইম্পোর্টস লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল মটরস, অটো ইম্পোর্টস লিমিটেড, অভি ট্রেডিং, টিবিএইচ কোং। এর মধ্যে অটো মিউজিয়াম একটি, এএএ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পোর্ট একটি, এশিয়ান ইম্পোর্টস লিমিটেড দুইটি, কন্টিনেন্টাল মটরস দুইটি, অটো ইম্পোর্টস লিমিটেড তিনটি, অভি ট্রেডিং একটি ও টিবিএইচ কোং পাঁচটি গাড়ি আমদানি করেছে। এই ১৭টি গাড়িতে শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
সাতটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি হলো অটো মিউজিয়াম লিমিটেড। এই আমদানিকারক ২০২২ সালের ১৮ মে জার্মানির তৈরি একটি পোরশে টাইকুন ফোর-এস যুক্তরাজ্যের ‘ওটেক লিমিটেড ইউকে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়িটি আমদানি করেছে। গাড়িটি ২০২১ মডেলের হলেও মডেল ২০২২ মডেল বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে আমদানি করা ‘ব্র্যান্ডনিউ পোরশে টাইকুন ইলেকট্রিক কার’ ঘোষণা দিয়ে গাড়িটি খালাস নেয়া হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাড়িটি ২০২১ মডেলের। যদিও গাড়িটি পোরশে টাইকুন ইলেকট্রিক কার নয়, গাড়িটি পোরশে টাইকুন ফোর-এস মডেলের। এই গাড়ির অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু বা শুল্কায়নযোগ্য মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় ৭১ লাখ টাকা। যদিও এই গাড়িটির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় ৮৭ লাখ টাকা। এই গাড়িতে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৬৩ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, যদিও এই গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর হবে প্রায় ৭৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এই গাড়িটিতে প্রায় পৌনে ১৪ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অপরদিকে, আমদানিকারক এএএ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পোর্ট ২০২৪ সালের ২৭ মার্চ যুক্তরাজ্য থেকে ২০২৪ মডেলের ‘ব্র্যান্ডনিউ পোরশে টাইকুন ইলেকট্রিক কার’ ঘোষণা দিয়ে গাড়িটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে খালাস নেওয়া হয়েছে। ঘোষণায় গাড়িটির মডেল ঠিক থাকলেও আদতে গাড়িটি ইলেকট্রিক গাড়ি নয়, মূলত গাড়িটি হলো ‘পোরশে টাইকুন জিটিএস’ মডেলের। জার্মানির তৈরি এই গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য দেখানো হয়েছে প্রায় এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা। যদিও গাড়িটির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় এক কোটি ৬২ লাখ টাকা। এই গাড়িতে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় এক কোটি ২৩ লাখ টাকা। যদিও এই গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর হবে প্রায় এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থা এই গাড়িতে প্রায় ২১ লাখ টাকার বেশি শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশি গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইম্পোর্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট গেইনফুল (গ্লোবাল) মটরস লিমিটেড থেকে দুইটি ২০২৪ মডেলের ‘ব্র্যান্ডনিউ মার্সিডিজ বেঞ্জ ই২০০’ গাড়ি আমদানি করেছে। ১৯৯৯ সিসির দুইটি গাড়ি-ই জার্মানির তৈরি। প্রতিটি গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। অনুসন্ধান বলছে, প্রতিটি গাড়ির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় ৯৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। প্রতিটি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় দুই কোটি হলেও পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় এক কোটি ৫৮ লাখ টাকা। প্রতিটি গাড়িতে প্রায় ৪২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। দুইটি গাড়িতে প্রায় ৮৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, আমদানিকারক কন্টিনেন্টাল মটরস। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ‘ব্র্যান্ডনিউ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিএলএস-৪৫০ হাইব্রিড এসইউভি’ ঘোষণায় যুক্তরাজ্য থেকে দুইটি গাড়িটি আমদানি করে। যুক্তরাষ্টের তৈরি প্রতিটি ২৯৯৯ সিসির গাড়ি ২০২২ মডেল ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে, মূলত গাড়ি দুইটি ২০২২ নয়, ২০২১ মডেলের। তবে গাড়ি দুইটি জিএলএস-৪৫০ ফোর-ম্যাটিক। প্রতিটি গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। যদিও গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতিটি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় দুই কোটি ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রতিটি গাড়িতে প্রায় ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা করে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি গাড়িতে প্রায় এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা করে দুইটি গাড়িতে প্রায় দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান অটো ইম্পোর্টস লিমিটেড। ২০২২ সালের ২৭ মার্চ ‘ব্র্যান্ডনিউ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিএলএস-৪৫০ হাইব্রিড এসইউভি’ ঘোষণায় যুক্তরাজ্যের গেইনফুল (গ্লোবাল) মটরস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দুইটি গাড়িটি আমদানি করেছে। যুক্তরাষ্টের তৈরি প্রতিটি ২৯৯৯ সিসির গাড়ি ২০২২ মডেল ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে, মূলত গাড়ি দুইটি ২০২২ নয়, ২০২১ মডেলের। তবে গাড়ি দুইটি জিএলএস-৪৫০ ফোর-ম্যাটিক। প্রতিটি গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৬২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। যদিও গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতিটি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় দুই কোটি ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু প্রতিটি গাড়িতে প্রায় ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা করে শুল্ককর পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি গাড়িতে প্রায় এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা করে দুইটি গাড়িতে প্রায় দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। একই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের গেইনফুল (গ্লোবাল) থেকে একই মডেল ও একই ব্র্যান্ডের একটি ও ৩০ মে দুইটিসহ মোট তিনটি গাড়ি আমদানি করেছে। অনুসন্ধান বলছে, তিনটি গাড়ির মডেল ২০২১ হলেও দেখানো হয়েছে ২০২২। দক্ষিণ আফ্রিকায় তৈরি প্রতিটি ১৪৯৬ সিসির গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ টাকা। অথচ এই দুইটি গাড়ির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় ৫৭ লাখ টাকা করে। আর প্রতিটি গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫১ লাখ হলেও পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ২৯ লাখ টাকা (প্রতিটি)। দুইটি গাড়িতে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি ২৯৯৯ সিসির গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে প্রায় ৬২ লাখ টাকা। অথচ এই গাড়ির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় এক কোটি ৭১ হাজার টাকা। প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় এক কোটি ৫১ লাখ টাকা হলেও পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই গাড়িতে শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে প্রায় ৫৮ লাখ টাকা।
অনুসন্ধান বলছে, আমদানিকারক অভি ট্রেডিং। ২০২৪ সালের ১৫ আগস্ট ‘ব্র্যান্ডনিউ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিএলই-৪০০ই পিএইচইভি জিপ’ ঘোষণায় যুক্তরাজ্যের আরডব্লিউ লিমিটেড ইউকে থেকে গাড়িটি আমদানি করে। যুক্তরাষ্টের তৈরি ১৯৯৯ সিসির গাড়িটি ২০২৪ মডেল ঘোষণা দেওয়া হয়। অনুসন্ধান বলছে, মূলত গাড়ি দুইটি ২০২৪ নয়, ২০২৩ মডেলের। তবে গাড়িটি হলো জিএলই-৪৫০ ফোর-ম্যাটিক। গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য ঘোষণা দেওয়া হয়েছে প্রায় ৭৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। যদিও গাড়িটির প্রকৃত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকা। এই গাড়িতে প্রযোজ্য শুল্ককর হবে প্রায় এক কোটি ৬৩ লাখ টাকা। কিন্তু এই গাড়িতে প্রায় একটি ৮৩ হাজার টাকা শুল্ককর পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই গাড়িতে প্রায় ৬২ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, আমদানিকারক টিবিএইচ কোং এআরকে গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজ পিটিই লিমিটেড থেকে ‘ব্র্যান্ডনিউ মার্সিডিজ বেঞ্জ জিএলএস-৪৫০ হাইব্রিড জিপ’ ঘোষণা দিয়ে আমদানি করেছে। পাঁচটি গাড়ি ২৯৯৯ সিসি ও ২০২২ মডেলের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চারটি গাড়ি ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর ও একটি ২০২৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আমদানি করা হয়। অনুসন্ধান বলছে, পাঁচটি গাড়ির মধ্যে দুইটি গাড়ি হলো ‘জিএলএস ৪৫০ ফোর-ম্যাটিক, অপর তিনটি ‘জিএলই ৪৫০ ফোর-ম্যাটিক’। পাঁচটি গাড়ি ২০২২ মডেল ঘোষণা দেওয়া হলেও দুইটি গাড়ি ২০২১ মডেলের। দুইটি গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য প্রায় ৫৩ লাখ (প্রতিটি), দুইটির প্রায় ৭৪ লাখ (প্রতিটি) ও একটি গাড়ির ৮৬ লাখ টাকা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে দুইটি গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হবে প্রতিটি প্রায় এক কোটি ৮৯ হাজার, অপর দুইটির মধ্যে প্রতিটির এক কোটি ১৪ লাখ ও একটির প্রায় এক কোটি ২৪ লাখ টাকা। পাঁচটি গাড়ির মধ্যে দুইটি গাড়িতে প্রায় ৭১ লাখ, অপর দুইটিতে প্রায় ৮৪ লাখ ও একটিতে ৮০ লাখ টাকা করে শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি গাড়িতে এই আমদানিকারক মোট প্রায় তিন কোটি ৯২ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমদানি করা অধিকাংশ গাড়ির যুক্তরাজ্যে আগে নিবন্ধন ছিলো। ফলে এসব গাড়ি ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণায় আমদানি করা হলেও মূলত এসব গাড়ি পুরাতন বা ব্যবহৃত গাড়ি। আমদানি নীতি আদেশ লঙ্ঘন করে মিথ্যা ঘোষণায় অবৈধভাবে এসব পুরাতন গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। আবার অনেক গাড়ির রপ্তানি সংক্রান্ত রেকর্ড যুক্তরাজ্যের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট পাওয়া যায়। অর্থাৎ এসব গাড়ির নিবন্ধন এখনো ওই দেশে রয়েছে। বাংলাদেশে গাড়িগুলো রপ্তানি হলেও তার কোনো তথ্য যুক্তরাজ্যের কাছে নেই। এছাড়া এসব গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি দেখা গেছে। এসব গাড়ির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মডেলভিত্তিক ম্যানুফ্যাকচারার সাজেসটেড রিটেইল প্রাইস (এমএসআরপি) উল্লেখ করা থাকে। যেহেতু এসব গাড়ি কোন ডিলারের মাধ্যমে আমদানি করা হচ্ছে না এবং ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণায় খুচরাভাবে ক্রয় করে আমদানি করা হচ্ছে-এক্ষেত্রে ডিলারের জন্য প্রযোজ্য কমিশন মূল্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ নেই। এরপরও দেখা গেছে, কাস্টম হাউস কর্তৃক ‘ডেটাবেস মূল্যে’র ভিত্তিতে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করে শুল্কায়ন করা হয়েছে, যা সেই এমএসআরপি হতে অস্বাভাবিকভাবে কম। ফলে ব্র্যান্ডনিউ গাড়ি আমদানিতে জালিয়াতি ও শুল্ককর ফাঁকি রোধে প্রতিবেদনে কাস্টম হাউস কমিশনারদের প্রতি পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া কমিশনারদের সর্তক করে কাস্টমস গোয়েন্দা থেকে পৃথক চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
সুপারিশগুলো হলো-ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণায় ডিলার ব্যতীত অন্যান্য আমদানিকারকের আমদানি করা গাড়ির ক্ষেত্রে শুল্কায়নের সুস্পষ্ট ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)’ বা নির্দেশনা প্রণয়ন; প্রতিটি গাড়ির পূর্ব নিবন্ধন ও রপ্তানির রেকর্ড যাচাই বাধ্যতামূলক করা; গাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া এমএসআরপি ভিত্তিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করে শুল্ক নির্ধারণ; এই ধরনের শুল্ক ফাঁকির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বিবেচনা; এবং গাড়ির কান্ট্রি অব অরজিন, কান্ট্রি অব এক্সপোর্ট ও পোর্ট অব এক্সপোর্ট এর মধ্যে অসঙ্গতি থাকলে তা বিশেষভাবে যাচাই করে প্রামাণ্য কাগজপত্র ও দলিল দাখিল করার বিধান করা।
এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বিজনেস বার্তাকে বলেন, ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণা দিয়ে পুরাতন গাড়ি আমদানি! আরো বিলাসবহুল গাড়ি! এটা এক ধরনের জালিয়াতি। অনুসন্ধানে যেসব গাড়ি পাওয়া গেছে এবং যাচ্ছে-সেসব গাড়ি রাস্তায় চলছে। বলা যায়, এসব গাড়ি অনেকটা মিথ্যা ঘোষণা ও শুল্ককর ফাঁকি দিয়েই আমদানি হয়েছে। সেজন্য এসব গাড়ি জব্দ বা পরবর্তী কি আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়-সেজন্য এনবিআরের কাছে আমরা চিঠি দিয়ে জানতে চেয়েছি। একইসঙ্গে সকল কাস্টম হাউসকে আমরা চিঠি দিয়েছি, যাতে যুক্তরাজ্য বা অন্যান্য দেশ হতে আমদানি করা ইউরোপীয় অরিজিনের ব্র্যান্ডনিউ ঘোষণার গাড়ি শুল্কায়নের ক্ষেত্রে অধিকতর সর্তকর্তা অবলম্বন করা হয়। এই ধরনের যেসব গাড়ি শুল্কায়নের অপেক্ষায় রয়েছে-সেসব গাড়ি কাস্টম হাউস চাইলে গাড়িগুলো ভেহিকল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (ভিআইএন) আমাদের দেওয়া হলে তা যাচাইয়ে সহযোগিতা করা হবে। অনুসন্ধানে আমরা চাঞ্চল্যকর তথ্য পাচ্ছি। সহসাই অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।
** চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস: অর্ধেক মূল্যে আমদানি ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি
** আইসিডি কাস্টম হাউস: অডি গাড়ির দামের চেয়ে শুল্ক কম, ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়ন
** মোংলা কাস্টম হাউস: অর্ধেক দামে আমদানি হচ্ছে সুজুকি, হাভাল, এমজি, মিৎসুবিশি
** ইউএনএইচসিআর: ৪৬ গাড়িতে ৫০ কোটি অর্থদণ্ড, গাড়ি চালায় কে?
** ব্র্যান্ড নিউ গাড়িতে অর্থ পাচার, শুল্কায়নে ‘দ্বিচারিতা
** শুল্কমুক্ত ২৪ গাড়ি হাতিয়ে নিতে সিন্ডিকেটের ফাঁদ
** শুল্ক সুবিধায় আনা দামি গাড়ি পড়ে আছে রাস্তায়
** জালিয়াতির ‘ষ্পোর্টস কারের’ দাম মাত্র ৬০ হাজার টাকা!
** তিন শিল্প গ্রুপ ও পাঁচ প্রতিষ্ঠান এনেছে ৮ রোলস রয়েস
** ‘মেঘনা’ ১০ কোটির নিশান দেড় কোটিতে বিক্রি করেছে
** বিএমডব্লিউ আমদানিতে ‘চতুরমুখী’ জালিয়াতি
** শুল্ককর না দিয়েই ‘রোলস রয়েস’ লুকালেন ব্যবসায়ী শরিফ
** শুল্কায়ন হয়নি, কিভাবে চললো ৩০০ কিলোমিটার?
** অটো মিউজিয়াম-রেঞ্জ রোভার-বিএমডব্লিউতে ১৩ কোটি টাকা জরিমানা