‘বাই মুরাবাহা প্লেজ’ ঋণের নামে ১৯,৩৪৯ কোটি টাকা লোপাট

এস আলম গ্রুপ পরিচালক পর্ষদের অনুমোদন ও জামানত ছাড়াই ইসলামী ব্যাংক থেকে ‘বাই মুরাবাহা প্লেজ’ ঋণের নামে ১৯,৩৪৯ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এ ঘটনায় ব্যাংকটির দুর্নীতিবাজ এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মওলা এস আলমের প্রধান সহযোগী ছিলেন।

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মওলা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে একক সিদ্ধান্তে এস আলমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ মঞ্জুর ও প্রদান করেন। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে বিপুল অর্থ বের করলেও সেখানে ঋণের মঞ্জুরিপত্র নেই, যা ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় সম্প্রতি তিনটি মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিটি মামলার আসামি তালিকায় মোহাম্মদ মনিরুল মওলার নাম থাকলেও তিনি স্বপদে বহাল তবিয়তে আছেন। রহস্যজনক কারণে তাকে গ্রেফতারে দুদকের কোনো উদ্যোগও নেই।

অন্যদিকে এই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ব্যাংক রক্ষা ও দুর্নীতি বন্ধে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ‘স্টার্ক টিম’। পরিচ্ছন্ন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে এই টিম।

স্টার্ক টিমের এক সদস্য জানান, গত নয় বছরে নামসর্বস্ব ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়ার আংশিক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। দুদকের মামলার পরও এস আলম ও মোহাম্মদ মনিরুল মওলাকে গ্রেফতার না করে তাদের অপকর্ম চালানোর সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

এস আলম গ্রুপের পলাতক কর্ণধারের ইশারায় স্বপদে বসে প্রভাব খাটিয়ে তিনি ঋণ জালিয়াতির সব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করছেন। যা নিন্দনীয় ও নজিরবিহীন।

এ ব্যাপারে জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ মনিরুল মওলার মোবাইল ফোনে সোমবার একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। একই নম্বরের হোয়াটস অ্যাপে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় জানিয়ে তার বক্তব্যের জন্য সময় চেয়ে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। রাত ১০টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব দেননি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দেওয়া কোনো ‘বিশেষ ঋণ’ ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদন করেনি। এসব ঋণ একক ক্ষমতায় অনুমোদন করেছেন এমডি, যার মাধ্যমে ১৯,৩৪৯ কোটি টাকা লোপাট করেছে এস আলম। বাই মুরাবাহা প্লেজ পদ্ধতিতে এই ঋণ দেওয়া হয়েছে, যেখানে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা পণ্য বিনিয়োগের বিপরীতে দেওয়া হওয়ার কথা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,ব্যাংকটির নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহক ব্যাংকের টাকায় পণ্য কিনে ব্যাংকের গুদামে রাখবে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বের করতে পারবে। কিন্তু এস আলম ১৯,৩৪৯ কোটি টাকার পণ্য ব্যাংক থেকে নিয়ে ১ টাকাও পরিশোধ করেনি, ফলে পুরো টাকাই অনাদায়ী রয়ে গেছে। আগের ঋণের টাকা আদায় না করেই পরবর্তী ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করা হয়েছে, আর এর প্রধান সহযোগী ছিলেন মোহাম্মদ মনিরুল মওলা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, এস আলমের যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিশেষ ঋণ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের নামে ১ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা, এস আলম এডিবল অয়েলের নামে ৩ হাজার ২৩২ কোটি, এস আলম রিফাইন্ড সুগার, এস আলম স্টিল ও এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের নামে ৩ হাজার ৬৮৪ কোটি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের নামে ৪ হাজার ৩৪৫ কোটি, চেমন ইস্পাতের নামে ৩ হাজার ৩৩৭ কোটি, ইনফিনিট সিআর স্ট্রিপস ইন্ডাস্ট্রিজের নামে ২ হাজার ২৮২ কোটি এবং গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের নামে ৯৭৫ কোটি টাকা। মোট ১৯ হাজার ৩৪৯ টাকার এই ঋণের বিপরীতে এক টাকাও জামানত নেই।

এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মওলা এক টাকাও পরিশোধ না করেও এস আলমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ধারাবাহিকভাবে বাই মুরাবাহা প্লেজ ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করেছেন। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এমডি শুধুমাত্র এলসি ও বাই মুরাবাহা প্লেজে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ মঞ্জুর করতে পারেন, কিন্তু তিনি নিয়ম উপেক্ষা করে ঋণ মঞ্জুর করেছেন। এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মওলা এক টাকাও পরিশোধ না করেও এস আলমের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ধারাবাহিকভাবে বাই মুরাবাহা প্লেজ ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করেছেন। ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, এমডি শুধুমাত্র এলসি ও বাই মুরাবাহা প্লেজে নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ঋণ মঞ্জুর করতে পারেন, কিন্তু তিনি নিয়ম উপেক্ষা করে ঋণ মঞ্জুর করেছেন।

জানা যায়, এই পুরো টাকাই বের করে নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে। ওই শাখায় এই ঋণের কোনো মঞ্জুরিপত্র নেই। করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট উইং-১ ও আইটি ডিভিশনের সহায়তায় এমডি এই অপকর্ম করেছেন। ব্যাংকের সফটওয়্যারে প্রত্যেকটি অপকর্মের রেকর্ড এখনো আছে।

ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এক লাখ টাকার বাই মুরাবাহা পণ্যের শর্টফলের কারণে জড়িতদের চাকরি চলে যাওয়ার নজির রয়েছে, কিন্তু ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি মুরাবাহা পণ্যের শর্টফলের জন্য এখনো কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। এমডিসহ জড়িত সবাই বহাল আছেন এবং ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এস আলমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি।

জানা গেছে,ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এস আলমের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় নীরব থাকলেও দুদক ইতোমধ্যে এস আলমের ছেলে, ভাইসহ ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তাকে আসামি করে তিনটি মামলা দায়ের করেছে। তিনটি মামলাতেই ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মওলাও আসামি, তবে গ্রেফতারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মনিরুল মওলা এখনও এমডি পদে বহাল আছেন এবং নিয়মিত অফিস করেন।

এদিকে মনিরুল মওলাকে গ্রেফতারসহ ব্যাংকের দুর্নীতি বন্ধে গঠিত স্টার্ক টিম বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে। টিমের এক সদস্য জানান, ব্যাংকের দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা প্রচার করা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে স্মারকলিপি দেওয়াসহ সংবাদ সম্মেলন করে জাতির সামনে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়া হবে।

টিমের আরেক সদস্য জানান, জুলাই বিপ্লবের পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এস আলমের কাছ থেকে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি, বরং এমডি এমন ব্যবস্থা করছেন যাতে টাকা আদায় করা না যায়। এস আলম গ্রুপের পলাতক কর্ণধারদের সঙ্গে এমডির নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে, এবং ব্যাংকের কোনো সংস্কার প্রস্তাব পেলেই তিনি তা ফিরিয়ে দেন।

জুলাই বিপ্লবের পর ইসলামী ব্যাংক মারাত্মক তারল্য সংকটে থাকলেও এমডি নির্বিকার ছিলেন। এস আলমের দোসররা অন্যান্য ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত হলেও ইসলামী ব্যাংকে তারা বহাল তবিয়তে আছেন। ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা লুট হওয়ার পরও এমডি মিডিয়ার সামনে দাবি করেছেন, সব ঋণ নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে। এর পরেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এমডির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!