জুলাই অভ্যুত্থানের সুযোগে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (ডাকসু) অভাবনীয় জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। জামায়াতে ইসলামীর সহযোগী এই সংগঠন যেখানে আগে কখনো ডাকসুর কোনো পদে জয়লাভ করতে পারেনি, সেখানে এবার ভিপি ও জিএসসহ ১২টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ৯টিই দখল করেছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে প্রায় ৪০ হাজার ভোটারের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ভোট প্রদান করেন। প্রায় সব হলে কেন্দ্রীয় ভিপি ও জিএস পদে শিবিরের দুই প্রার্থীই বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে থাকেন। বিশেষ করে মেয়েদের হলে শিবির প্রার্থীরা পান নজিরবিহীন সমর্থন। এ নির্বাচনে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রার্থীরা, তবে কোনো পদেই তারা জয় পাননি। সম্পাদকীয় তিনটি পদ শিবিরের হাতছাড়া হলেও সেখানে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ডাকসুর ভিপি পদে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি আবু সাদিক কায়েম। নুরুল হক নুরের উত্তরসূরী হিসেবে দেশের বৃহত্তম এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নেতৃত্ব দেবেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষার্থী। ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের প্রার্থী সাদিক কায়েম পেয়েছেন ১৪,০৪২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান ৫,৭০৮ ভোট পেয়েছেন। জিএস পদে ছাত্রশিবিরের এসএম ফরহাদ ১০,৭৯৪ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারী হামিম পেয়েছেন ৫,২৮৩ ভোট। এজিএস পদে জয়ী হয়েছেন শিবিরের মুহা. মহিউদ্দীন খান। তিনি পেয়েছেন ১১,৭৭২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৫,০৬৪ ভোট।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১টার দিকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ফল ঘোষণা শুরুর পর থেকেই শিবির সমর্থিত প্যানেলের বড় জয়ের আভাস মেলে। নানা ধরনের গুঞ্জনের মধ্যে ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথগুলোতে জড়ো হন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী। উত্তেজনার আভাসে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা কড়াকড়ি বাড়ানো হয়। রাত ৩টার দিকেই ক্যাম্পাসের কয়েক জায়গায় ছাত্রশিবিরের কর্মীদের বিজয় মিছিল শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে কারচুপির অভিযোগ তুলে ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান এবং স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা। ১৮ হলের ফল জড়ো করে সমন্বিত ফল প্রস্তুত করতে রাত পেরিয়ে যায়। বুধবার সকাল ৮টার পর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা করেন ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম উদ্দিন। ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদের উদযাপনও পূর্ণতা পায়।
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে এবারই প্রত্যক্ষভাবে প্রথম সরকারি দল সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ছাড়া ডাকসু নির্বাচন দেখল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ নির্বাচনে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরসহ রাজনৈতিক সংগঠন ও স্বতন্ত্র হিসেবে অন্তত ১০ প্যানেল অংশ নিলেও ছাত্রশিবির একচেটিয়া জয় পেয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকায় থাকা শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) নির্বাচনে খুব একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারেনি। ছাত্রশিবির তাদের ৪৮ বছরের ইতিহাসে এবারের মত এতটা প্রকাশ্যে, অবাধে, চাঙ্গাভাব নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ আর কখনো পায়নি।
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে রাজনীতি বন্ধ ছিল। ওই সময় শিবিরের সঙ্গে জাতীয় পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্র সমাজের’ রাজনীতি বন্ধের বিষয়ে জোটবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি চালানোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু ওই সময় ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনে সক্রিয় থেকে শিবির কর্মীরা যে গোপনে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, সেই সত্য প্রকাশিত হয় চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর। ছাত্রশিবিরের কর্মীরা এবার নিজেদের সাংগঠনিক পরিচয় নিয়েই অবাধে ডাকসু নির্বাচনে নিজেদের হাজির করেছেন; শেষে তারাই হাসলেন জয়ের হাসি।
সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম উদ্দিন যখন বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করছিলেন, তখন সেখানে ভিপিপ্রার্থী সাদিক কায়েমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন রাত জাগার ক্লান্তি উপেক্ষা করে বিজয় উৎসব করতে থাকা কর্মী-সমর্থকরা। ভিপি পদে বিজয়ীর নাম ঘোষণার আবার স্লোগানে মেতে ওঠেন ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা।
সম্পাদক পদে শিবির সমর্থিত প্যানেলের বিজয়ীরা
ভিপি: সাদিক কায়েম; ভোট: ১৪,০৪২
জিএস: এসএম ফরহাদ; ভোট: ১০,৭৯৪
এজিএস: মহিউদ্দীন খান; ভোট: ১১,৭৭২
মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক: ফাতিমা তাসনীম জুমা (ইনকিলাব মঞ্চ); ভোট: ১০,৬৩১
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক: ইকবাল হায়দার; ভোট: ৭, ৮৩৩
কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক: উম্মে সালমা; ভোট: ৯, ৯২০
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক: জসীমউদ্দিন খান (খান জসীম); ভোট: ৯৭০৬
ক্রীড়া সম্পাদক: আরমান হোসেন; ভোট: ৭,২৫৫
ছাত্র পরিবহন সম্পাদক: আসিফ আব্দুল্লাহ; ভোট: ৯,০৬১
ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক: মাজহারুল ইসলাম; ভোট ৯, ৩৪৪
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক: আব্দুল্লাহ আল মিনহাজ; ভোট: ৭,০৩৮
মানবাধিকার ও আইন বিষয়ক সম্পাদক: সাখাওয়াত জাকারিয়া; ভোট: ১১, ৭৪৭
তিনটি সম্পাদক পদে জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক: মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ; ভোট: ৭৭৮২
সমাজসেবা সম্পাদক: যুবাইর বিন নেছারী; ভোট: ৭,৬০৮
গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক: সানজিদা আহমেদ তন্বি; ভোট: ১১,৭৭৮
এদিকে রাত আড়াইটার দিকে ফল ঘোষণার প্রাথমিক পর্যায়েই তা প্রত্যাখ্যান করেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদ। নিজের ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে তিনি লেখেন, পরিকল্পিত কারচুপির এই ফলাফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি। নিজেদের মতো করে সংখ্যা বসিয়ে নিন। এই পরিকল্পিত প্রহসন প্রত্যাখ্যান করলাম। তবে তার ‘রানিং মেট’ জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম শিক্ষার্থীদের রায়কে সম্মান জানানোর কথা বলেন। রাত সোয়া ২টার দিকে নিজের ফেইসবুক পেইজে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন- এটিই তাদের রায়, তবে এই রায়কে আমি সম্মান জানাই। আমি শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষমাণ।