গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চান ৬৭.৬৭% মানুষ: বিবিএস জরিপ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে যে, দেশের মানুষের কাছে মুদ্রিত সংবাদপত্রের প্রতি আগ্রহ কিছুটা কমেছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৯.২৮% মানুষ মুঠোফোনে সংবাদ পড়েন, যার তুলনায় ৩৭.৬১% মানুষ এখনো ছাপা পত্রিকা পড়েন। কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবলেটে সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ দেখা হয় ২.৫৪% মানুষের। সর্বোপরি, ৬৭.৬৭% মানুষ চান যে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করুক এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক বা অন্যদিকে প্রভাবিত না হয়। আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে জরিপের ফলাফল সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছে।

বিবিএস জানায়, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জানুয়ারি দেশের ৬৪ জেলার ৪৫ হাজার খানা (হাউসহোল্ড) থেকে ১০ বছরের বেশি বয়সী সদস্যদের কাছ থেকে উত্তর সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরদাতাদের ২৩ হাজার ১৪৫ জন নারী আর ২১ হাজার ৯০০ জন পুরুষ।

এই জরিপের মাধ্যমে দেশে গণমাধ্যমের বিস্তার, মানুষের সংবাদ গ্রহণের অভ্যাসের পরিবর্তন, গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদির বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে বলে জানিয়েছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন।

সংবাদপত্র পড়তে অনীহা-

জরিপে অংশ নেওয়া নারী–পুরুষের মাত্র ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা সংবাদপত্র পড়েন। তাঁদের মধ্যে পুরুষ ৩৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। নারী ২০ দশমিক ৫১ শতাংশ। অন্যদিকে সংবাদপত্র পড়েন না ৭৩ শতাংশ মানুষ। এ ক্ষেত্রে নারীর হার বেশি, ৭৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। পুরুষ ৬৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।

মুঠোফোনে আগ্রহ বেশি-

কে কোন মাধ্যমে সংবাদপত্র পড়েন—এমন প্রশ্নের জবাবে দেখা গেছে, ছাপা সংবাদপত্র পড়েন মাত্র ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে পুরুষ ৪২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। নারী ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ। মুঠোফোনে অনলাইন সংস্করণে খবর দেখেন ৫৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। পুরুষ ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ, নারী ৬৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাবে সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণ দেখেন ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ। তাঁদের মধ্যে ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ নারী ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ পুরুষ।

সংবাদপত্র না পড়ার কারণ-

মানুষের সংবাদপত্র না পড়ার কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে যেটি উঠে এসেছে—প্রয়োজন মনে না করা। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৬ দশমিক ৫২ শতাংশ মানুষ সংবাদপত্র পড়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ২৬ দশমিক ২৩ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা পড়তে পারেন না। সময় না পাওয়াকে কারণ হিসেবে বলেছেন ১৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ মানুষ। জরিপে অংশ নেওয়া ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ সংবাদপত্র না পড়ার পেছনে নিজেদের আর্থিক অসামর্থ্যের কথা বলেছেন। দশমিক ৩৬ শতাংশ মনে করছেন, সংবাদপত্র বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

টেলিভিশন কত মানুষ দেখে-

ছাপা সংবাদপত্রের আবেদন কমলেও মানুষের মধ্যে টেলিভিশন দেখার আগ্রহ একেবারে কম নয়। জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৬৫ দশমিক ৪২ শতাংশ টেলিভিশন দেখেন। আর ৩৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ টেলিভিশন দেখেন না। লৈঙ্গিক বিবেচনায় ৭১ দশমিক ৩১ শতাংশ পুরুষ টেলিভিশন দেখেন। নারীদের মধ্যে এ হার ৫৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

তলানিতে রেডিও-

সংবাদমাধ্যম হিসেবে রেডিওর অবস্থান এখন একেবারে তলানিতে। মাত্র ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ নারী–পুরুষ বলছেন, তাঁরা রেডিও শোনেন। অন্যদিকে ৯৩ দশমিক ৯৩ শতাংশই রেডিও শোনেন না। রেডিও না শোনা মানুষের মধ্যে নারী ৯৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। পুরুষ ৯২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

রেডিও না শোনার প্রধান কারণ মানুষের প্রয়োজন মনে না করা। জরিপে অংশ নেওয়া নারী–পুরুষের ৫৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ রেডিও শোনাকে আর প্রয়োজন মনে করেন না। ৩৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ বলছেন, রেডিও এখন সহজলভ্য নয়। রেডিও শোনার সময় পান না ৭ শতাংশ মানুষ। আর্থিকভাবে সামর্থ্য নেই ২ দশমিক ৫৪ শতাংশের। দশমিক ২৮ শতাংশ মনে করছেন রেডিওর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে।

দুর্যোগে ভরসা টেলিভিশন-

জাতীয় দুর্যোগ কিংবা সংকটের সময় তথ্য পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ৩৫ দশমিক ১৭ শতাংশ মানুষ টেলিভিশনের ওপর ভরসা করেন। জরিপে দেখা গেছে, দুর্যোগকালে তথ্যপ্রাপ্তিতে ২৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ মানুষের ভরসা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ মানুষ ভরসা করেন বিশ্বাসযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে। এ ছাড়া বিশেষ সেই সময়ে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষের ভরসা ছাপা পত্রিকায়। ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশের অনলাইন সংবাদমাধ্যমে। আর দশমিক ৫৭ শতাংশ রেডিও এবং দশমিক ৪৯ শতাংশ খুদে বার্তায় ভরসা করেন।

খবরের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সামাজিকমাধ্যম-

জরিপে উত্তরদাতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল—খবরের জন্য সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনটি? জবাবে ৩১ দশমিক ৩৬ শতাংশ ফেসবুকের কথা বলেছেন। ইউটিউবের কথা জানিয়েছেন ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া রয়েছে এক্স (দশমিক ৫৮ শতাংশ), ইনস্টাগ্রাম (দশমিক ২৫ শতাংশ), টিকটক (দশমিক ৮০ শতাংশ), ম্যাসেঞ্জার (দশমিক ৫৯ শতাংশ) ও টেলিগ্রাম (দশমিক ২৮ শতাংশ)।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা-

জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ১৭ দশমিক ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন দেশের সংবাদমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীন। ২৪ দশমিক ১৮ শতাংশের মতে অনেকটাই স্বাধীন। গণমাধ্যমকে কিছুটা বা কদাচিৎ স্বাধীন বলে মনে করেন ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্যদিকে ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বলেছেন, দেশের সংবাদমাধ্যম কোনোভাবেই স্বাধীন নয়।দেশের গণমাধ্যম কেন স্বাধীন নয়? এই প্রশ্নের একাধিক উত্তর দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। এর পেছনে ৭৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। আর সরকারি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন ৭১ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন ৫০ দশমিক ১৪ শতাংশ।

গণমাধ্যম স্বাধীন না থাকার পেছনে ৩১ দশমিক ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতা সাংবাদিকদের ব্যক্তিস্বার্থের কথা বলেছেন। এ ছাড়া আরও রয়েছে মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ (২৪ দশমিক ১৭ শতাংশ), বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ (১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ)। উত্তর দিতে গিয়ে ‘জানা নেই’ বলেছেন ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। জরিপে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ উত্তরদাতা কারণ বলতে চাননি।

বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশে সীমাবদ্ধতা-

জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের ৪৭ দশমিক ২২ শতাংশ বলেছেন সাংবাদিকদের সঠিক বা বস্তুনিষ্ঠ খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে না–সূচক উত্তর দিয়েছেন ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা।এর কারণ কী? জবাবে জরিপের উত্তরদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৬ দশমিক ৬ শতাংশ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। এ ছাড়া সরকারি হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন ৬৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন ৪৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ।এ ক্ষেত্রে ২৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ উত্তরদাতা সাংবাদিকদের ব্যক্তি স্বার্থের কথা বলেছেন। মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ (২২ দশমিক ৭১ শতাংশ), বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপের (১২ দশমিক ১৫ শতাংশ) কথা বলেছেন। জরিপে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা কারণ বলতে চাননি।

যেমন সংবাদমাধ্যম চান-

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ গণমাধ্যমকে স্বাধীন দেখতে চান। নিরপেক্ষ বা পক্ষপাতহীন দেখতে আগ্রহী ৫৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এ ছাড়া ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ সরকারি প্রভাবমুক্ত, ৩৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বস্তুনিষ্ঠ, ৩০ দশমিক ৫৭ শতাংশ সাধারণ নাগরিকদের চাহিদা পূরণে সক্ষম, ১৬ দশমিক ১৬ শতাংশ হলুদ সাংবাদিকতামুক্ত, ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ ব্যবসায়িক প্রভাবমুক্ত, ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ আর্থিক প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম দেখতে চান বলে মত দিয়েছেন।৫৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশ টেলিভিশনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে দেখতে আগ্রহী। এর বিপক্ষে রয়েছেন ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ মানুষ। আর বাংলাদেশ বেতারের সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত বলে মনে করছেন ৫৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা। বেতারের সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধী ৩০ দশমিক ৬৬ শতাংশ মানুষ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!