কৃত্রিম অঙ্গের ঘোষণায় ৪৫০ টন জুয়েলারি আমদানি

প্রায় ৪৫০ টন জুয়েলারি (গয়না) পণ্য আমদানি হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের পণ্যের জন্য প্রতি টনে ৩ লাখ টাকা হারে কর দেওয়ার কথা। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের অঙ্ক দাঁড়ানোর কথা ছিল কয়েক কোটি টাকা। কিন্তু কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে অসাধু আমদানিকারকেরা জুয়েলারিকে ‘কৃত্রিম মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এতে কর নেমে আসে প্রতি টনে মাত্র ৩ হাজার টাকায়। কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীর যোগসাজশে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৩ কোটি টাকা।

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে কর ফাঁকির ওই ঘটনায় প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে বিভাগীয়ভাবে তদন্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চলমান আন্দোলন ও দ্বন্দ্বের কারণে বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। রাজস্ব ফাঁকির এ অনিয়মে জড়িত কর্মকর্তা হলেন মো. মাহমুদুল হাসান, যিনি বর্তমানে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

গত ১২ মে এনবিআর পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে সরকার রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ জারি করে। এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এনবিআর কর্মকর্তারা আন্দোলনে নামেন এবং দেশব্যাপী কর্মবিরতি শুরু হলে রাজস্ব আদায়ে মারাত্মক অচলাবস্থা দেখা দেয়। পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। আন্দোলনে কারা জড়িত ছিলেন তা শনাক্ত করতে সম্প্রতি সরকারের একাধিক সংস্থা অনুসন্ধানে নামে। এতে কমিশনার মো. মাহমুদুল হাসানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানকারীদের মতে, কাস্টমস কমিশনারদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তিনি তারেক রিকাবদারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে সব মেম্বারকে অফিসে আটকে রাখা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, মেম্বাররা বাইরে যেতে না পারলে সচিবালয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না।

কর্মকর্তাদের মতে, আন্দোলনে যুক্ত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১৩ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ঘটনাও আবার সামনে এসেছে, যা আগে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। সে সময় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মো. মাহমুদুল হাসান সোনামসজিদ স্থলবন্দরে যুগ্ম কমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকার সময় মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানির ঘটনা ঘটে। তিনি কৃত্রিম মানব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নামে খুব কম শুল্কে বিপুল পরিমাণ সোনা ও গয়না আমদানির সুযোগ দেন। এমনকি তিনি নিজেই বিল অব এন্ট্রিতে সই করেন, যা সাধারণত সহকারী কমিশনারদের দায়িত্ব।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৪৫০ টন কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে এত বিপুল পরিমাণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমদানির কোনো বাস্তব প্রয়োজন ছিল না। আসলে এসব চালানে ছিল জুয়েলারি পণ্য। কর ফাঁকির উদ্দেশ্যে সেগুলোকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালের ২১ জানুয়ারি বিল নম্বর ১২৩৭–এ ১৪ টন, ১৯ জানুয়ারি বিল নম্বর ১০২২–এ ২০ দশমিক ১৪ টন, ১০ ফেব্রুয়ারি বিল নম্বর ১৫০০–এ ১১ দশমিক ৫ টন এবং ৮ ফেব্রুয়ারি বিল নম্বর ১৪৮৫–এ ১১ টন কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আমদানির ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ৮ টন, ১৩ ডিসেম্বর ১৩ দশমিক ৫ টন এবং ৫ ডিসেম্বর ৬ দশমিক ৫ টন আমদানির রেকর্ড পাওয়া যায়। তবে বাস্তবে এসব চালানে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিল না, ছিল জুয়েলারি পণ্য। এ ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে মেসার্স দিয়া এন্টারপ্রাইজ (বালুবাড়ী, দিনাজপুর), মেসার্স শুভ এজেন্সি (সোনামসজিদ, শিবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ), মেসার্স মায়ের দোয়া হার্ডওয়্যার স্টোর (গোদাগাড়ী, রাজশাহী) এবং মেসার্স আইডিয়া ইমপ্যাক্ট (বিজয়নগর, ঢাকা)।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সোনামসজিদ স্থলবন্দরে দায়িত্বে থাকাকালে মো. মাহমুদুল হাসান একক সিদ্ধান্তে লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সদস্যসচিব তপন চন্দ্র দেকে না জানিয়ে ছয়জন সি অ্যান্ড এফ এজেন্টকে লাইসেন্স দেন। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এনবিআরের নির্দেশনা ভঙ্গ করে এভাবে লাইসেন্স প্রদান দেশের অন্য কোনো বন্দরে ঘটেনি। অভিযোগ রয়েছে, এই অনিয়মের বিনিময়ে মাহমুদুল হাসান অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার মাহমুদুল হাসানের মতো ব্যক্তি রাজস্ব সংস্থার দায়িত্বে থাকা শুধু সংস্থার জন্য নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও গুরুতর হুমকি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের কমিশনার মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমি বিস্তারিত আপনার কাছ থেকে শুনলাম। এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করব না।’

এনবিআর কর্মচারীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এতে সক্রিয়ভাবে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সরকার। ইতোমধ্যে একাধিক কর্মকর্তাকে, যার মধ্যে কমিশনারও রয়েছেন, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

** হরহামেশা ব্যবসায়ীরা মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করছেন
** মিথ্যা ঘোষণায় যন্ত্রাংশ আমদানি করে ‘টেকনো-ইনফিনিক্স’
** কেমিক্যাল ঘোষণায় ফেনসিডিল ও বিদেশি ঔষধ আমদানি
** কমলা ঘোষণায় সিগারেট, ৩০ কোটি ফাঁকির চেষ্টা
** ঘোষণা ইলেকট্রিক মোটর, আমদানি হয়েছে ‘নিডো দুধ’
** ফেব্রিক্স ঘোষণায় ইপিজেডের প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে কন্টেইনার ভর্তি মদ
** সোডা অ্যাশ ঘোষণায় ১৭ কোটি টাকার মদ আমদানি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!