২০২১ সালে অর্ডার নেওয়ার পর পণ্য সরবরাহ না করায় ২৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫৪৮ কোটি টাকা আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাবে টাকা স্থানান্তরের আগেই গ্রাহকের অর্থ আটকে দেওয়া হয়। নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গত চার বছরে সরকার ৪২১ কোটি টাকা গ্রাহকদের কাছে ফেরত দিয়েছে। তবে আবেদন না পাওয়ায় এখনও ৭টি পেমেন্ট গেটওয়ের কাছে ১২৭ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ২০২৩ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক হিসাব থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রতারণার ঘটনায় ই-কমার্স গ্রাহকদের অর্থের খুব অল্প অংশই আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ, সে সময় নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর আগেই পেমেন্ট গেটওয়ে এক-দুই দিনের মধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের হিসাবে টাকা স্থানান্তর করত। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুতই ওই অর্থ তুলে নেয়। পরবর্তীতে পণ্যের অর্ডার নেওয়ার পর অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পণ্য সরবরাহ না করার ঘটনা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকলে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক ই-কমার্সে পরিশোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়, গ্রাহক পণ্য হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কোনো পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (পেমেন্ট গেটওয়ে) ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা ছাড় করতে পারবে না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য না পৌঁছালে, সেই টাকা গ্রাহককে ফেরত দিতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল’। এই সেল অর্থ ছাড়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাছাই ও হিসাব করে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ৫৫ হাজার ২১১ জন গ্রাহকের অর্ডারের বিপরীতে সাতটি পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান মোট ৫৪৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা আটকে রাখতে সক্ষম হয়। এই অর্থের মধ্যে গত চার বছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সেলের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে ৪০৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা রিফান্ড দেওয়া হয়েছে। পেমেন্ট গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো চার্জ হিসেবে কেটে নিয়েছে ৫ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই চার্জও ফেরত দেওয়া হয়েছে। যেমন—ফোস্টার করপোরেশন কিউকম ডটকমের গ্রাহকদের ৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং আমারপে বাংলাদেশ ডিলের গ্রাহকদের ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা চার্জ বাবদ ফেরত দিয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, এখনো ১২৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকা পেমেন্ট গেটওয়েগুলোর কাছে আটকে রয়েছে, যা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রাহক অর্ডার করেও পণ্য পাননি—এ বিষয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে। সেই তালিকার ভিত্তিতেই পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থ গ্রাহকদের রিফান্ড করা হয়েছে। তবে যেসব অর্থের বিপরীতে তালিকা পাওয়া যায়নি, সেগুলো এখনো ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, মালিকরা পলাতক, কেউ কেউ কারাগারে আছেন কিংবা ডেটাবেস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে—এসব কারণে বাকি অর্থের গ্রাহক তালিকা পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে গত অক্টোবর মাসে নতুন করে গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ গ্রহণ শুরু হয়। তবে সেখানে একটি জটিলতা দেখা দিয়েছে—অনেকে পণ্য পাওয়ার পরও দাবি করছেন, তারা পাননি। কেউ কেউ আবার ১০টি পণ্যের অর্ডার দিয়ে ৮টি পেয়েছেন, অথচ দাবি করছেন পুরোপুরি পণ্য হাতে পাননি।এর পেছনে অন্যতম কারণ, শুরুতে এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। ফলে নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়েছে।
আটকে থাকা টাকার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক তালিকা
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আটকে ছিল কিউকমে। গ্রাহকরা এর মধ্যে ৩৪২ কোটি ২ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন, এখনও ৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা আটকে আছে যা ফোস্টার করপোরেশনের কাছে রয়েছে। ই-অরেঞ্জের ৩৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আটকা পড়ে ছিল, তবে মালিকদের তালিকা না দেয়ায় এ থেকে একটাকাও ছাড় পায়নি। সর্বাধিক আলোচিত ইভ্যালির পেমেন্ট গেটওয়েতে ২৬ কোটি ৮২ লাখ টাকা আটকা ছিল, যার মধ্যে ৮ কোটি টাকা পরিশোধ হয়েছে, বাকি ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা আটকে আছে। অন্য প্রতিষ্ঠান দালাল প্লাসের ৩৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকার মধ্যে ১৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, আলেশা মার্টের ৪২ কোটি ৭৩ লাখ টাকার মধ্যে ২ কোটি ৪১ লাখ টাকা, আলিফ ওয়ার্ল্ডের ২ কোটি ৫৩ লাখ টাকার মধ্যে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা এখনও পরিশোধ হয়নি। বাকি ১৯টি প্রতিষ্ঠানের ১৩ কোটি ১৩ লাখ টাকার মধ্যে ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা বাকি রয়েছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ
আটকে থাকা অর্থ পরিশোধ নিশ্চিত করতে গত বছরের ২৮ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক ও বিক্রেতাদের কাছে অভিযোগ আহ্বান করে একটি গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। একই সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অনলাইন পোর্টালে অভিযোগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ভোক্তা অধিদপ্তরের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গণবিজ্ঞপ্তির পর থেকে সংস্থাটির কাছে মোট ৫৬ হাজার নতুন অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২৯ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৪০ হাজার এবং নির্ধারিত সময়ের পর আরও ১৬ হাজার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে নিষ্পত্তি না হওয়া ২২ হাজার অভিযোগ থাকায় বর্তমানে ই-কমার্স সংক্রান্ত মোট অনিষ্পন্ন অভিযোগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার। তবে এসব অভিযোগের বিপরীতে গ্রাহকদের পাওনা অর্থের সঠিক পরিমাণ এখনও জানা যায়নি।