অ্যাসাইকুডা হ্যাকে কাস্টমস কর্মকর্তা-সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট

কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের সার্ভারে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে পণ্য খালাসের অভিযোগে করা মামলার তদন্তে উঠে এসেছে দেশি-বিদেশি কোম্পানি, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের নাম। একটি চক্র অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কর্মকর্তাদের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার কিংবা হ্যাক করে বিপুল সংখ্যক কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে-এমন অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ঘটনার সঙ্গে কয়েকজন প্রভাবশালী কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতাও মিলেছে। এসব জালিয়াতির ঘটনায় রমনা থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় সম্প্রতি চার্জশিট দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। চার্জশিটে অন্তত নয় জন ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন আমদানি-রপ্তানির শুল্ক ব্যবস্থাপনার সফটওয়্যার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড’। কাস্টমস কর্মকর্তাদের অ্যাসাইকুডার সরকারি আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে পণ্য খালাসে জড়িত সংঘবদ্ধ একটি চক্র তিন বছরের বেশি সময় ধরে এই সার্ভারের অবৈধ ব্যবহার চালিয়ে গেছে। চক্রটি এই সার্ভারে ২০১৬ সাল থেকে ৩ হাজার ৬৬১ বার লগইন করে। চট্টগ্রাম কাস্টম, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এ কাজে জড়িত। এ চক্রে দেশি-বিদেশি অন্তত ১৯ প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে। এমন ভয়াবহ জালিয়াতির পরও চলতি বছর একইভাবে অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। পরে গত মাসে সফটওয়্যারের নিরাপত্তা জোরদার করে এনবিআর।

এই মামলার সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদেশি কোম্পানির সহযোগিতায় দেশীয় আমদানিকারক কম শুল্কের পণ্য দেখিয়ে মদ ও সিগারেটের মতো উচ্চ শুল্কের পণ্য এনেছে। এভাবে তারা বিপুল অঙ্কের টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছে। তাদের এমন অপকর্মে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও যোগসাজশ ছিল। এনবিআরের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে ঢুকে অবৈধভাবে খালাস করা হয়েছে আটকে থাকা ২২টি চালান, যেখানে অন্তত ২১১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সিআইডির দায়ের করা একটি মামলার চার্জশিটের একটি কন্টেইনারের মালামাল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪০ ফুটের একটি কন্টেনাইরের মাধ্যমে সিগারেট আমদানি করা হয়। এই একটি কন্টেইনারেই শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এই শুল্ক ফাঁকিতে নয় জন ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত।

সিআইডির জমা দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মামলার ১ নম্বর আসামি গোলাম মোস্তফা নামের এক ব্যবসায়ী, তিনি মিমি লেদার কটেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা উচ্চ শুল্কের সিগারেটের আমদানি করেছেন এই ব্যবসায়ী। তার পণ্য খালাস স্থগিত রাখা হয়েছিল। তবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স এম অ্যান্ড কে ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক মোফাজ্জেল হোসেন মোল্লার সঙ্গে যোগসাজশে স্থগিত রাখা সেই চালানটি খালাস করার জন্য সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কর্মচারী আবদুল গোফরান এবং জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে অবৈধভাবে কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা সার্ভারে প্রবেশ করে। স্থগিত থাকা পণ্যের স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে জেটি সরকার রাহাত হোসেন, আলাউদ্দিন মোল্লা, ওহিদুল হাওলাদার, সুমন, জহিরুল ইসলাম, আব্দুল গোফরান ও রমজান আলীদের মাধ্যমে পণ্য খালাস করা হয়।

অভিযোগপত্রে কাস্টমস কর্মকর্তা আসামি হিসেবে যুক্ত না থাকার কারণ হিসেবে সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু ব্যবসায়ীদের অপরাধের বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছে সিআইডি। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেবে দুদক।

তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এআইআর শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহম্মেদের নেতৃত্বে সহকারী প্রোগ্রামার কামরুল হক, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ, উচ্চমান সহকারী আব্দুল্লাহ আল মাছুম, অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলামসহ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কন্টেইনার খালাস করার চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিদেশ থেকে আনা মদ ও সিগারেটসহ উচ্চ শুল্কের পণ্য কম শুল্ক দেখিয়ে কন্টেইনার খালাস করে। সন্দেহভাজন পণ্যের কন্টেইনার লক করে দেওয়ার পরও তারা কাগজপত্র জালিয়াতি করে খালাস করেছেন।

অ্যাসাইকুডা হ্যাকের ঘটনায় দায়ের করা দুদকের একটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মুভিং ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল হংকং থেকে চাইনিজ নিউ টায়ার আমদানির ঘোষণা দেয়। পণ্যটির ব্যাপারে মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে- এমন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চালানটির খালাস কার্যক্রম সাময়িক বন্ধের জন্য শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে ২০১৮ সালের ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয়। নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে পণ্য চালানটির কায়িক পরীক্ষা করা হয়নি। এর পরও একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর চালানটি ছাড়ে অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়। এই অনাপত্তিপত্র তৈরি, ইস্যু, ডেসপাস ও বিতরণের সঙ্গে রাজস্ব কর্মকর্তা সুলতান আহম্মদ, কম্পিউটার অপারেটর ফিরোজ, উচ্চমান সহকারী আব্দুল্লাহ আল মাছুম, অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম জড়িত ছিলেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করার পর এর শুল্কায়ন থেকে শুরু করে সবকিছুই হয় এনবিআরের ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেম’ সফটওয়্যারের মাধ্যমে। দেশের সব বন্দর এই সফটওয়্যারের আওতায় কাজ করে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা হয় কাকরাইলে এনবিআরের কার্যালয় থেকে। কোনো চালান ছাড়তে না চাইলে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে সেটা বন্ধ করারও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা আছে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আনার খবরে কন্টেইনারগুলো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ছাড় করানো বন্ধ (লক) করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চক্রটি নামমাত্র শুল্ক দিয়ে কন্টেইনারগুলো ছাড় করায়। সশরীরে কন্টেইনার পরিদর্শনের পর খালাসের নির্দেশনা থাকা পণ্যও চক্রটি চিঠি জাল করে খালাস করেছে।

তদন্ত কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানিয়েছে, অ্যাসাইকুডা সফটওয়্যার থেকেই এসব চালান ছাড় করে দেওয়া হয়েছে। আর এ জন্য ব্যবহার করা হয়েছে দুজন কাস্টমস কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড। দুই কর্মকর্তার মধ্যে মহিবুল ইসলাম ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে চাকরি শেষে অবসরে যান। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেড় বছর তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে ছিলেন। আর ফজলুল হক ২০১৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত ছিলেন। নিয়ম অনুসারে, একজন কর্মকর্তা বন্দরে নিয়োগের পর তার নামে আইডি ও পাসওয়ার্ড তৈরি করে দেওয়া হয়। আর কর্মকর্তারা কর্মস্থল ত্যাগ করার সময় লিখিতভাবে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানালে সেই আইডি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে চক্রের সদস্যরা কর্মকর্তাদের আইডি বন্ধ না করেই সেই আইডির মাধ্যমের পণ্য ছাড় করে শত শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, দুই ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে চালানগুলো খালাস করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু চালান ছাড় করানো হয় দুজন কাস্টমস কর্মকর্তার চুরি করা আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। আর বাকি চালান ছাড় করানো হয়েছে জালিয়াতি চক্রে যুক্ত থাকা কাস্টমস কর্মকর্তার অনাপত্তির চিঠির মাধ্যমে।

একাধিক জালিয়াতির পর এনবিআরের টনক নড়ে

ভয়াবহ জালিয়াতির অর্ধযুগ পরও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের গত ২০ মে এক কর্মকর্তার অগোচরে তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে এক কন্টেইনার সিগারেট খালাস করে একটি চক্র। এসব ঘটনার পর গত মাসে এনবিআর জানিয়েছে, প্রাথমিক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এনবিআর দেখেছে- সিস্টেম হ্যাক করে নয়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অবর্তমানে তার কম্পিউটার থেকে আইডি ও পাসওয়ার্ড চুরি করে তা ব্যবহারের মাধ্যমে মালামাল খালাসের ঘটনা ঘটে।

এনবিআর বলছে, যেসব কর্মকর্তার ‘অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডে’ প্রবেশাধিকার আছে, নিরাপত্তার খাতিরে লগইনের জন্য টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু করা হয়েছে। তার মানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে যাওয়া ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) ছাড়া সিস্টেমে প্রবেশের সুযোগ নেই। ব্যবহৃত ডিভাইসের (কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন) আইপির বিবরণ সিস্টেমে যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে অন্য কোনো ডিভাইস থেকে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। এখন থেকে প্রতি ২১ দিন পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসওয়ার্ড রিসেট এবং সবশেষ ব্যবহৃত তিনটি পাসওয়ার্ড বাতিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

** এক কর্মকর্তার নামে পণ্য শুল্কায়ন করেন অন্যজনএক কর্মকর্তার নামে পণ্য শুল্কায়ন করেন অন্যজন
** ঝুঁকিতে অ্যাসাইকুডা সিস্টেম বারবার আইডি-পাসওয়ার্ড চুরি খোঁজ মেলে না দোষীদের
** চট্টগ্রাম কাস্টমসের তদন্তে গায়েব ৩০ কনটেইনার!
** বাতিল হওয়া সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্সে ৬৭১ চালান খালাস!
** অবসরে কর্মকর্তা আইডি সচল
** অ্যাসাইকুডা জালিয়াতি অনুসন্ধানে দুদক
** আইডি জালিয়াতিতে সাত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট
** অভিযুক্ত ৬৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করবে শুল্ক গোয়েন্দা
** ‘এনবিআর সার্ভার হ্যাকিংয়ে জড়িতরা চিহ্নিত’
** অভিযুক্ত সাত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স স্থগিত করল কাস্টমস
** আইডির অপব্যবহার খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি
** মদ কাণ্ডের সবই ‘জাল’
** ‘যোগসাজসে’ খালাস হয় মদের চালান‘যোগসাজসে’ খালাস হয় মদের চালান

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!