৯০ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ, করফাঁকি ১৩ কোটি

বায়রার সাবেক মহাসচিব স্বপন

** সিআইসি অনুসন্ধানে নেমে দেশের ভেতরে স্বপনের সাকুল্যে ৯০ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পায় কিন্তু আয়কর বিবরণীতে আছে অনেক কম
** আয় ও সম্পদের তথ্য গোপন করে তিনি ফাঁকি দিয়েছেন সরকারের প্রায় ৯ কোটি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৭ টাকা। ফাঁকি দেওয়ায় জরিমানা হওয়ার কথা আরও ৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৬১ কোটি টাকা

রুহুল আমিন স্বপন একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। যার প্রধান ব্যবসা বিদেশে শ্রমিক রপ্তানি। এই কাজের আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়ার অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমে তার বিরুদ্ধে করফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিময়-দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতির তথ্য পাচ্ছেন এনবিআর। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) অনুসন্ধানে তার অনিয়ম-দুর্নীতি, বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি, অর্থপাচারের তথ্য উঠে এসেছে। বিদেশি শ্রমিক পাঠানোর এজেন্সিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস-বায়রা এর সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল নামে প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। তবে সদ্য বিদায় নেয়া সরকারের আমলে স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হলেও বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদলে সুবাদে সেই অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান আবার শুরু হয় এবং এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। তবে সিআইসির তদন্তে উঠে আসা সব অভিযোগের সঙ্গে একমত নন ক্যাথারসিসের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ব্যবস্থাপক শাহ আজম।

ঢাকার ভাটারা থানার অধীন মাদানী অ্যাভেনিউয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির রিক্রুটিং এজেন্সি হিসেবে কাজ করছে ক্যাথারসিস। সরকারের উচ্চপর্যায়ে আঁতাত করে চলা স্বপনের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগ বেশ পুরনো। গোয়েন্দারা বলছেন, এই কাজে মালয়েশিয়ায় তার বড় সহযোগী আনিমুল ইসলাম বিন আমিন নূর, যিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ার নাগরিক। আমিন নূরের সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট’ করে সরকারি খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বাড়তি টাকা নেওয়া, সঠিক কাজ না দেওয়াসহ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়ে অর্থপাচারের নানা অভিযোগে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়েছেন এই স্বপন।মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে আমিন নূরের সঙ্গে কারসাজি করে ১০০টি এজেন্সির একটি চক্র বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

সিআইসি কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে এই চক্রের জাল-জালিয়াতি, সঠিক কাজ না দেওয়া, নিবন্ধন ও মেডিকেলের নামে বাড়তি অর্থ নেওয়া এবং অর্থপাচারের মত অভিযোগের কারণে বাংলাদেশের জন্য মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজারের দরজা বারবার বন্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ গত মে মাসে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ হয় তাদের জন্য। রুহুল আমিন স্বপনের অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অবৈধ পন্থায় বিদেশে সম্পদ গড়ার তথ্য এলেও সেসবের পুরোপুরি খবর এখনও দেশের গোয়েন্দা সংস্থারও জানার বাইরে। তবে দেশেও গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদের পাহাড়, যার পদে পদে রাজস্ব ফাঁকিসহ নানা অসুদপায় অবলম্বন করেছেন তিনি। ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের বাইরে স্বপনের মালিকানায় রয়েছে ক্যাথারসিস মেডিক্যাল সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রেইনিং সেন্টার, ক্যাথারসিস ট্রাভেলস, মীম মেডিকেল সেন্টার এবং ক্যাথারসিস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড। রুহুল আমিন স্বপন বিভিন্ন সময়ে যেমন বিপুল পরিমাণ এফডিআর স্থিতি, ব্যাংক স্থিতি, গৃহ সম্পত্তিতে বিনিয়োগ, ব্যাংক সুদের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন, তেমনি ভুয়া ব্যাংক বিবরণী ও বাড়ি কেনার তথ্য দিয়ে আয়ও গোপন করেছেন বলে উঠে এসেছে সিআইসির প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, জনশক্তি রপ্তানির টাকা দুবাইয়ে পাচার করে সেই অর্থ রেমিটেন্স হিসেবে দেশে এনে বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দেওয়ার পাশাপাশি রেমিটেন্সের বিপরীতে বাড়তি প্রণোদনাও নিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্নেহাভাজন হিসেবে পরিচয় তৈরি করেছিলেন স্বপন। সেই প্রভাব খাটিয়ে সিআইসির অনুসন্ধান বন্ধ করতে বারবার চেষ্টাও করেছিলেন ক্যাথারসিসের মালিক।

সিআইসির একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগের সরকারের আমলেই আমরা অনুসন্ধান শুরু করি। কিন্তু বারবার আটকে দেওয়ার চেষ্টা হয়। তদন্তের সময় একবার আমাকে সাবেক অর্থমন্ত্রী তার অফিসে ডাকলেন। আমি গিয়ে দেখি, অর্থমন্ত্রীর পাশেই বসে আছেন রুহুল আমিন স্বপন। খুব বিব্রত বোধ করেছিলাম তখন। স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান তখন আর এগোতে না পারলেও ক্ষমতার পালাবদলের এই সময়ে এসে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার নির্দেশনা দেন সিআইসির মহাপরিচালককে। স্বপনের অনিয়মের মালয়েশীয় সহযোগী আমিন নূর, যিনি দাতো শ্রী আমিন নামে পরিচিত।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মূলত মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে চুক্তির আওতায় কোন কোন প্রতিষ্ঠান শ্রমিক পাঠাতে পারবে, তা নিয়েই সিন্ডিকেট করতেন আমিন ও স্বপন। এই চক্রের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকার জায়গায় গড়ে ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা নেওয়ার তথ্য উঠে আসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক প্রতিষ্ঠানের জরিপে। প্রতি কর্মীর কাছ থেকে নিবন্ধন ফি ১০০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত (প্রায় ২ হাজার ৭০০ টাকা) নেওয়ার কথা থাকলেও নেওয়া হত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার টাকা।বেস্টিনেটের অভিবাসন-বিষয়ক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এফডব্লিউসিএমএস এরও বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।

শ্রমিক নিয়োগের আবেদন বাবদ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা, মাইগ্রামস রেজিস্ট্রেশন ও বায়োমেডিকেল বাবদ ৫ হাজার ৪শ টাকা, অটো অ্যালোকেশনের সিস্টেম ফি বাবদ দেড় লাখ টাকা, ভিসা ট্রেডিং বাবদ ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা নিয়েছে এফডব্লিউসিএমএস ব্যবহার করে।বিমানের টিকেটের ক্ষেত্রে চক্র বানিয়ে বাড়তি ভাড়া নেওয়া, ই-ভিসা বাবদ ৭ হাজার টাকা, বিএমইটি ও আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তি নিয়েছে আমিন-স্বপন সিন্ডিকেট। সিআইসি মূলত এই সিন্ডিকেটের খবর পেয়েই স্বপনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল।

আয়কর ফাঁকি

স্বপনের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ আসে অর্থপাচারের। কিন্তু এর বেশিরভাগই ব্যাংকিং বা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে না হওয়ায় সব তথ্য প্রতিবেদনে উঠে আসেনি বলে দাবি গোয়েন্দাদের। সিআইসি অনুসন্ধানে নেমে দেশের ভেতরে স্বপনের সাকুল্যে ৯০ কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পায়। এর মধ্যে সবশেষ ২০২২-২৩ করবর্ষে ৬২ কোটি ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ১৯৩ টাকার সম্পদ আয়কর বিবরণীতে দেখান স্বপন; বিপরীতে কর দেন ৫৩ লাখ টাকা। অথচ আয় ও সম্পদের তথ্য গোপন করে তিনি ফাঁকি দিয়েছেন সরকারের প্রায় ৯ কোটি ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪৭ টাকা। ফাঁকি দেওয়ায় জরিমানা হওয়ার কথা আরও ৪ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৬১ কোটি টাকা। তবে এসব সম্পদ কেবল ব্যাংকিং ও ফরমাল চ্যানেলের হিসাব বলে প্রতিবেদনে বর্ণনা করেছেন কর্মকর্তারা। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর এখন দেশে থাকা জমি ও বাড়িতে গিয়ে সেখানের সত্যিকার মূল্যমান খুঁজে বের করার ভার পড়েছে কর অঞ্চল-৮ এর ওপর।

যে কারণে আরও অনুসন্ধান

স্বপন জমি কিনতে অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ দেখিয়েছেন জানিয়ে সিআইসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বনানীতে সাত কাঠা ১৩ দশমিক ৫ ছটাক জমি সাড়ে ৪ কোটি টাকায় কিনেছেন। ২০১৮-১৯ করবর্ষে রেজিস্ট্রেশনসহ ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বিনিয়োগ দেখিয়েছেন।অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই জমির বিক্রেতা মো. শওকত ইকবাল এবং তার ভাই মো. শাহীন ইকবালকে জমির মূল্য বাবদ পরিশোধ করা পে-অর্ডার, পে-অর্ডার ইস্যুর আবেদন ফরম, বিক্রেতাদের ব্যাংক বিবরণী ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখা যায় স্বপন সাড়ে ৪ কোটি করে সাকুল্যে ৯ কোটি টাকা দিয়েছেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে সব পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের এই তথ্য আমলে নিলেও জমির মূল্য দাঁড়ায় ৯ কোটি টাকা, যেখানে তিনি অর্ধেক মূল্যই গোপন করেছেন। তবে বনানীর মত জায়গায় এই জমির মূল্য আরও বেশি বলেই প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে সিআইসি। এনবিআরের এ গোয়েন্দা সংস্থাটি জমির বিক্রেতাদের অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তারা এর বেশি মূল্য স্বীকার করেননি। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মত, ক্যাশ টাকা দিলে আমাদের জন্য ধরা কঠিন। এখন সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল সম্পদের অ্যাসেসমেন্ট করবে।

ভবন নির্মাণে গোপন বিনিয়োগ

একই রকম তথ্য মিলেছে রুহুল আমিন স্বপনের বারিধারায় ‘নেসা হাউজ’ নামের নয় তলা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও। ভবনটি পাঁচ কাঠা তিন ছটাক জমির ওপর গড়ে তোলা। ভবনটির নিমার্ণশৈলী বিলাসবহুল, অত্যাধুনিক ও উন্নতমানের। সিআইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নয় তলা ভবনে চারটি ডুপ্লেক্স রয়েছে। এর একটিতে স্বপন নিজে বসবাস করেন। এর জমি ও ভবন নির্মাণসহ বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। কিন্তু অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, জমিসহ এই দালান নির্মাণে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৪৩ হাজার ১১৪ টাকা। অর্থাৎ এখানে তার অপ্রদর্শিত বিনিয়োগ ৬ কোটি ৭১ লাখ ৪৩ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। স্বপন বড় রকমের জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন ‘ক্যাথারসিস টাওয়ার’ নির্মাণের ক্ষেত্রেও। তিনটি বেইজমেন্টসহ ১৩তলা বিলাসবহুল আবাসিক ভবনটি সাত কাঠা ১৩ দশমিক ৫ ছটাক জমির ওপর বানানো হয়েছে। এই ভবন নির্মাণের জন্য রুহুল আমিন স্বপন কেবল ৯০ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৫ টাকার আংশিক বিনিয়োগ বা খরচ দেখিয়েছেন। অনুসন্ধানে গিয়ে গোয়েন্দারা পেয়েছেন, ভবনটি তৈরিতে তদারকি করেছে স্বপনের মালিকানাধীন ডেভেলপার কোম্পানি ক্যাথারসিস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড। ক্যাথারসিস টাওয়ারে নির্মাণে ক্ষেত্রে স্বপনের গোপন করা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার ২৬৭ টাকা।

সিআইসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে ১০তলা একটি বিলাসবহুল আবাসিক ভবন তৈরিতেও একইভাবে বিনিয়োগের তথ্য গোপন করেছেন স্বপন। তিনি ২০২২-২০২৩ করবর্ষের রিটার্নে জমির মূল্যসহ ভবনটির আংশিক বিনিয়োগ দেখান ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৩১ হাজার ৩২৪ টাকা। ভবনটির সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ২০২২-২০২৩ করবর্ষে প্রতিফলিত হওয়ার কথা থাকলেও তিনি তা করেননি। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তারা বলছেন, এই ভবনের জন্য বিনিয়োগ করতে হয়েছে ১১ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৮৯০ টাকা। অর্থ্যাৎ স্বপন গোপন করেছেন ৬ কোটি ৯১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৬ টাকার বিনিয়োগ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবনগুলোর প্রাক্কলিত সর্বমোট বিনিয়োগ হিসাব চূড়ান্ত নয়; একটি সম্ভাব্য পরিগণনা মাত্র। ক্যাশ বিনিময় হিসাব করলে এর পরিমাণ আরও বাড়বে বলেই গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা। সিআইসির তদন্তে উঠে আসা ভবনের কথা স্বীকার করেছেন ক্যাথারসিসের বিজনেস ডেভলপমেন্ট ব্যবস্থাপক শাহ আজমও। তবে তিনি বলেন, এগুলো তো আমাদের মালিকেরই। তবে তদন্তকারীরা ২০২২ সাল থেকে আসছেন। এখন এক প্রকার সল্ভড হয়ে বিষয়টি কর সার্কেলে গেছে। তদন্তে যেসব অভিযোগের সত্যতা তারা পেয়েছে বলে জানিয়েছেন, আমরাও সেগুলোর কিছু অভজারভেশন দিয়েছি। যেসব ডকুমেন্টস চেয়েছেন, আমরা তা দিয়েছি। বিদেশে অর্থ পাচার করে পরে রেমিট্যান্স হিসেবে দেখানোর অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে শাহ আজম বলেন, আমরা আমাদের প্রমাণ দেখাতে পারব। ভবন নির্মাণের প্রকৃত মূল্য গোপন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যেটা হয়েছে, আমরা সিটি করপোরেশন ও ড্যাপের নিয়ম অনুযায়ী তখন সেসব প্রদর্শন করেছি। আংশিকের বাইরে যা ছিল, তা পরবর্তী করবর্ষে কন্টিনিউ হবে। আমরা আমাদের এ অভজারবেশন জানিয়েছি।

কিন্তু আইন অনুযায়ী সে বছরের আয়কর বিবরণীতে দেখানোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে ক্যাথারসিসের এই কর্মকর্তা বলেন, কর সার্কেল থেকে যদি আমাদের আবার ডিমান্ড করা হয়, আমরা আইন অনুযায়ী সব দেব। আমাদের তো আইনের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নাই। আর আমাদের কিছু (আইনি) করার থাকলে করব। নয় কোটি টাকার জমির তথ্য সাড়ে চার কোটি টাকা দেখানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কর ফাইল নিয়ে বসলে এটি বোঝা যাবে।

ক্যাথারসিসের মূলধন জালিয়াতি

২০২০-২০২১ করবর্ষে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের স্থিতিপত্রে মূলধন জালিয়াতি তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, করদাতা ২০১৯-২০২০ করবর্ষে রিটার্নের সঙ্গে দাখিলকৃত করদাতার (স্বপন) এক মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল এর হিসাব বিবরণীর ফর্দে ব্যবসার সমাপনী মূলধন প্রদর্শন করেন ৫ কোটি ৯০ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩১ টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে ২০২০-২০২১ করবর্ষে রিটার্নের সঙ্গে দাখিলকৃত হিসাব বিবরণীর ফর্দে করদাতা ওই সমাপনী মূলধন (যা ২০২০-২০২১ করবর্ষের প্রারম্ভিক মূলধন হিসাবে বিবেচ্য) কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে আাইনবহির্ভুতভাবে পরিবর্তন করে ঋণাত্মক মূলধন ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৩৪ টাকা দেখায় ক্যাথারসিস। গোয়েন্দারা বলছেন, রুহুল আমিন এই ক্ষেত্রে মূলধন গোপন করেছেন ১৩ কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ৭৬৫ টাকা।

ব্যবসার আয় যেভাবে রেমিটেন্স হলো

জনশক্তি রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত ব্যবসায়িক আয়কে রেমিটেন্স হিসেবে দাবি করে কর ফাঁকি দিয়ে রেমিটেন্সের বিপরীতে স্বপন প্রণোদনাও নিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, রুহুল আমিনের দাখিল করা বিবেচ্য করবর্ষগুলোর আয়কর রিটার্ন পরীক্ষা করে দেখা যায়, তিনি একজন নিবাসী করদাতা। কিন্তু তার এক মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল এর মাধ্যমে মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি (রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যবসা) করে আয় প্রাপ্ত হন তিনি। মালয়েশিয়ান কোম্পানি রেডউড ফার্নিচার নামক কোম্পানীর সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি পাঠানো বা নিয়োগের চুক্তি করেছেন তিনি। এ চুক্তির আওতায় ইনভয়েস ও সুইফট মেসেজে ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালের নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব বিবরণী পরীক্ষা করে দেখা যায়, করদাতা ইনওয়ার্ড কমার্শিয়াল রেমিট্যান্স নামে ২০২৩ সালের অক্টোবরের ১০ তারিখে ১৮ লাখ ৯২ হাজার ৩৩৫ টাকা বা ১৭ হাজার ২০৩ ডলার এবং একই বছরের অগাস্টের ২৯ তারিখে ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ০৪৫ টাকা বা ৩৫ হাজার ৭৩৩ ডলার ওই মালয়শিয়ান কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত হন।

করদাতার (স্বপন) ওই আয় বাংলাদেশে উপচিত এবং ব্যবসায়িক করযোগ্য আয় হিসেবে বিবেচ্য। কিন্তু করদাতা এরূপ প্রমাণাদি বিগত করবছরগুলোতে রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করেননি। ফরমাল চ্যানেল ও ব্যাংকিং তথ্যের বাইরে অন্য তথ্য যাচাই করা গেলে রুহুল আমিনের আরও অঢেল সম্পদের তথ্য ও তার বিপরীতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির প্রকৃত তথ্য জানা যাবে বলে মনে করেন সিআইসির একাধিক কর্মকর্তা।

সিআইসি কর্তৃক সংগৃহীত করদাতার নামে জনতা ব্যাংক লিমিটেড, দুবাই শাখায় পরিচালিত ব্যাংক হিসাব নম্বর সিডি/০১/০০০০৯৩১২ এর ব্যাংক বিবরণী পরীক্ষা করে দেখা যায়, করদাতা (স্বপন) মালয়শিয়া থেকে ওই ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তর করেছেন।এর বিপরীতে স্বপন বিদেশে কর্মরত থাকার প্রমাণ, কাজের নিয়োগপএ, কার্যাদেশ বা ওয়ার্কওর্ডার দাখিল করেননি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এতে প্রতীয়মাণ হয় যে, স্বপন তার জনশক্তি ব্যবসার আয় বাংলাদেশে না এনে আরব আমিরতে দুবাইয়ে পাচার করে সেই অর্থ দিয়ে ওয়েজ আর্নার্স ডেভলপমেন্ট বন্ড বা ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড কিনে বিনিয়োগ করেছেন কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈদেশিক রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশে এনে করযোগ্য ব্যবসায়িক আয়কে বৈদেশিক রেমিট্যান্স হিসেবে দাবি করে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন।

রুহুল আমিন স্বপন ২০১০-১১ করবর্ষ থেকে ২০২০-২১ করবর্ষ পর্যন্ত সাকুল্যে ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা ওয়েজ আর্নার্স ডেভলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন। এছাড়া ২০১০-১১ ও ২০১৫-১৬ করবর্ষে দুইবারে ১ কোটি ৪৮ লাখ কোটি টাকা ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করেছেন। তবে এসব বিনিয়োগের পুরোটা তিনি আয়কর বিবরণীতে দেখাননি। তিনি আয়কর বিবরণীতে ২০১৬-২০১৭ করবর্ষে ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা এবং ২০২২-২০২৩ করবর্ষে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮৬২ টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে দেখিয়েছেন।এসবের বাইরে ব্যাংক স্থিতির তথ্য গোপন, মেরামত ব্যয় না দেখান, ভাড়ার থেকে আয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপদর্শন রেখে তিনি আয়কর কম দিয়েছেন বলে প্রমাণ মিলেছে তদন্তে। তার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ পাচারের অভিযোগ সে অনুযায়ী বিদেশে থাকা সম্পদের তেমন কোনো তথ্য এখনও পাননি গোয়েন্দারা। এসবের তথ্য বের করতে পারলে স্বপনের অবৈধ সম্পদ বা কর ফাঁকির অনেক কিছু সম্পর্কেই পরিষ্কার হওয়া যাবে বলে মনে করেন একাধিক কর্মকর্তা।

***

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!