ব্যবসায়ী শওকত আলী চৌধুরী, যিনি ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং শিপিং খাতের পরিচিত উদ্যোক্তা, তার পরিবারসহ আট হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত আগস্টে সংস্থাটির করা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে আসে। বিএফআইইউর মতে, শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের ব্যাংক হিসাবের এসব লেনদেন সন্দেহজনক। সংস্থাটির ধারণা, নানা অনিয়মের মাধ্যমে অর্থপাচার করে বিদেশে সম্পদও গড়ে তুলেছেন তিনি। বিষয়টি বিএফআইইউ’র তদন্তে রয়েছে। ইতিমধ্যে ওই প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনকেও (দুদক) পাঠানো হয়েছে। দুদক তা প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য যাচাই-বাছাই কমিটিতে (যাবাক) পাঠিয়েছে।
বিএফআইইউ’র খসড়া প্রতিবেদনে জানা গেছে, শওকত আলী চৌধুরী, তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীন, মেয়ে জারা নামরীন ও ছেলে মো. জারান আলী চৌধুরীর নামে এখন পর্যন্ত ২৮টি ব্যাংকে মোট ১৮৭টি হিসাব চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে শওকত আলী চৌধুরীর নামে রয়েছে ১৪টি, তার স্ত্রীর নামে ১৫টি, জারা নামরীনের নামে ৯টি এবং জারান আলী চৌধুরীর নামে ৩টি হিসাব। এছাড়া তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে আরও ১৪৬টি হিসাব পাওয়া গেছে।
চলতি বছরের ১৫ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৮ হাজার ৪০৭ কোটি ৯১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮২.২২ টাকা। একই সময়ে উত্তোলন করা হয়েছে ৮ হাজার ২৪৭ কোটি ৫৬ লাখ ৯২ হাজার ৭৬০.৩১ টাকা। ওই সময় হিসাবগুলোতে স্থিতি ছিল ১ হাজার ৭৩ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ১৫৮.১৬ টাকা। উল্লেখিত হিসাবসমূহের কেওয়াইসি, লেনদেন বিবরণী ও অন্যান্য দলিলও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বিএফআইইউ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, শওকত আলী চৌধুরী ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় একটি প্লাটিনাম হিসাব খোলেন এবং ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর তা বন্ধ করেন। এই হিসাবে মোট জমা হয় ৩ হাজার ৯৮৭ কোটি ৯৬ লাখ ৩ হাজার ২৭৪.৩১ টাকা এবং উত্তোলন হয় ৩ হাজার ৯৮৬ কোটি ২৩ লাখ ২ হাজার ৮৩৫.২৪ টাকা। হিসাব বন্ধের সময় স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৯.০৭ টাকা। এই হিসাবে তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসএন করপোরেশনের লেনদেন পরিচালনা করেছেন, যা ট্যাক্স ফাঁকির উদ্দেশ্যে হতে পারে বলে সংস্থাটির অনুসন্ধানে সন্দেহ করা হয়েছে। এ ছাড়া শওকত আলীর ব্যক্তিগত ইবিএল প্রিমিয়াম সেভিংস হিসাব থেকে ইস্টার্ন ব্যাংকের কোম্পানি সেক্রেটারি মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন মোট ১২৫ বার নগদ অর্থ উত্তোলন করেছেন। ব্যক্তিগত হিসাব থেকে ব্যাংকের একজন কর্মকর্তার এভাবে বারবার অর্থ উত্তোলন ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত বহন করে বলে বিএফআইইউ জানিয়েছে।
এস. এন করপোরেশনের নামে পরিচালিত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সিসি (হাইপো) ধরনের হিসাব থেকে শওকত আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী তাসমিয়া আম্বারীনের মালিকানাধীন আরেকটি প্রতিষ্ঠান নামরীন এন্টারপ্রাইজে অর্থ জমা করা হয়েছে এবং শিপ ব্রেকিং খাতের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে অর্থ জমা করা হয়েছে। তাছাড়া, নিড ড্রেসেস প্রা. লি. নামক একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটি ৪০ লাখ টাকা জমা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিএফআইইউ’র বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর প্রিমিয়ার ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা শওকত আলীর প্রতিষ্ঠান এস. এন করপোরেশনের একটি ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ২৬৯ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার ৬৪৬.৯০ টাকার এলটিআর সুবিধা অনুমোদন ছাড়াই প্রদান করে। পরবর্তীতে ১০ অক্টোবর ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে ওই এলটিআরের পোস্ট-ফ্যাক্টো অনুমোদন পাঠানো হয়, যা শাখা ১৪ অক্টোবর গ্রহণ করে। অর্থাৎ, নিয়ম অনুযায়ী অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও গ্রাহককে সুবিধা দিতে ব্যাংকিং নীতিমালা ভঙ্গ করে এ ঋণসুবিধা প্রদান করা হয়।
বিএফআইইউ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যের নামে সিঙ্গাপুর, দুবাই ও যুক্তরাজ্যে সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুরে দু’টি বাড়ির তথ্য পাওয়া যায়। আর অন্য দুই দেশের সম্পদের তথ্যগুলো নিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানিয়েছে সূত্রটি।
গত ১ জুলাই শওকত আলী চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বিএফআইইউ। পরে ৩০ জুলাই সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. তানভীর হাসান স্বাক্ষরিত আদেশে বলা হয়েছে, মো. শওকত আলী চৌধুরী, তাসমিয়া আম্বারীন, জারা নামরীন ও মো. জারান আলী চৌধুরী এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত থাকবে ৩১ জুলাই থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত। এই স্থগিতাদেশ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩(১) (গ) ধারার আওতায় দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্থগিতাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯-এর ২৬(২) বিধি প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।