৬৫ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট বাড়ছে, দাম বাড়তে পারে

বাড়তি আদায় হবে ১২ হাজার কোটি টাকা

** সিগারেটে দাম ও রাজস্ব বাড়ছে, সিগারেট খাত থেকে বাড়তি আদায় হবে ৪ হাজার কোটি টাকা
** অভ্যন্তরীণ ও আর্ন্তজাতিক রুটের বিমান টিকেটে আবগারি শুল্ক বাড়ছে, ফলে টিকেটের দাম বাড়বে
** পোশাক শো-রুম, হোটেল, রেস্তোঁরা, আর্টিফিশিয়াল ড্রিংসে ভ্যাট বাড়ছে, মদের বারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ছে
** মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার খরচও বাড়বে; ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ডে ভ্যাট দিতে হবে

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে ৬৫ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে-জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো কেচাপ বা সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকিট। রেস্তোরাঁ, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। এছাড়া ভ্যাট বাড়ানোর ফলে খরচ বাড়তে পারে পোশাক ব্র্যান্ডের শো-রুম, মিষ্টির দোকান, এইচআর কয়েল।

এমনকি মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট ব্যবহার খরচও বাড়বে। তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। মদের বারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ফলে মদ্যপীয়দের খরচ বাড়তে পারে। আবার আর্টিফিসিয়াল ড্রিংকস (সব ধরনের জুস) এর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। যেসব পণ্যে ভ্যাট পাঁচ, সাড়ে সাত ও দশ শতাংশ রয়েছে-সেসব খাতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান রেয়াত নিতে পারবে। শুধু স্থানীয় পর্যায় নয়, আমদানি পর্যায়েও কয়েকটি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে।

এনবিআর সূত্রমতে, রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে খাবারের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হবে। এত দিন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বা এসি রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হতো। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ জন্য মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইনে কিছু সংশোধন আনা হয়েছে। এসব সংশোধনীসহ মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ–২০২৫–এর খসড়া সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং সাপেক্ষে বুধবার (২ জানুয়ারি) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

এনবিআরের প্রতিবেদন বলছে, রেস্তোরাঁর পাশাপাশি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাটের হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেটি হলে পোশাক কেনার খরচও বাড়বে মানুষের। এ ছাড়া মিষ্টি কিনতে গেলেও খরচ বাড়তে পারে ভোক্তার। কারণ, মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কেনার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভ্রমণের ক্ষেত্রে নন-এসি হোটেল সেবার ভ্যাট হারও বাড়তে পারে। বর্তমানে নন–এসি হোটেল সেবার ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। সেটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেস্তোরাঁ, পোশাক, হোটেল ছাড়াও অন্য যেসব খাতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসতে যাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো উৎপাদন পর্যায়ে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্রান্সফরমার, টিস্যু পেপার ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বানানোর সময়ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হতে পারে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়। নতুন প্রস্তাব অনুসারে, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসতে পারে। এ ছাড়া মদের বিলের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মদের পাশাপাশি আমদানি, উৎপাদন ও সেবা পর্যায়ে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে যাচ্ছে সরকার। যেমন আমদানি পর্যায়ে ফলের রসে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ; তামাকে ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ; সুপারিতে ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোনের কথা বলায় (টকটাইম) সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হতে পারে।

সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়বে, বাড়বে দাম

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিগারেট খাত হলো রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় খাত। চলতি অর্থবছর সিগারেটের দাম ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। তবে অর্থবছরের বাকি ছয়মাসে দাম ও শুল্ক আরো বাড়ানো হচ্ছে। এনবিআর বলছে, ডব্লিউএইচও’র নির্দেশনা ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে সিগারেট খাতে দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। প্রতিবেদন বলছে, সম্পূরক শুল্ক দেড় শতাংশ হারে বাড়ানো হচ্ছে। দাম নিম্নস্তরে ৫ টাকা ও উচ্চ, মধ্যম ও প্রিমিয়াম স্তরে ১০ টাকা করে বাড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ বর্তমানে নিম্নস্তরের ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করা হচ্ছে। এতে সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এছাড়া ১০ শলাকার প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দাম ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা, উচ্চ স্তরের ১০ শলাকার দাম ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা ও মধ্যম স্তরের ১০ শলাকার দাম ৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হচ্ছে। তিনটি স্তরের সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হচ্ছে। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, আগামী ছয়মাসে সিগারেট খাত থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।

বিমান টিকেটের দাম বাড়বে

এনবিআর সূত্রমতে, চলতি বছর ব্যাংক খাতে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিমান টিকেটে গত কয়েক বছর ধরে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়নি। ব্যাংক খাতে আর্থিক নিরাপত্তা ও বাধ্য হয়ে মানুষ টাকা রাখে। তার উপর প্রায় সব হিসাবধারীকে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। কিন্তু বিদেশ ভ্রমণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে নয়—কখনো কর্মের, আবার কখনো ভ্রমণের জন্য যেতে হয়। ফলে বিমান টিকেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করে এনবিআর। শুধু বাড়ানো নয়, কিছু ক্ষেত্রে যৌক্তিকীকরণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেজন্য এনবিআরের প্রতিবেদনে ‘দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট এক্ট, ১৯৪৪’ সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, অভ্যন্তরীণ রুট ও সার্কভূক্ত দেশের বিমান টিকেটে ৫০০ টাকা হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এটা যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন। সেজন্য অভ্যন্তরীণ রুটে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৭০০ টাকা ও সার্কভূক্ত দেশে বর্তমানের দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হচ্ছে। এছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে দুই হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তিন হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। আবগারি শুল্ক বাড়ার ফলে টিকেটের দাম বাড়তে পারে।

মোবাইলে কথা বলা ও ইন্টারনেট খরচ বাড়বে

সহজ পন্থায় ভ্যাট আদায় করতে এবারও এনবিআর মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট খরচকে বেছে নিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় মোবাইল ফোনের সম্পূরক শুল্ক একদফা বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ করা হয়। এতে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭২ টাকার সেবা (কথা বলা ও ইন্টারনেট) পেতেন ব্যবহারকারীরা। আইএমফের চাপে একই অর্থবছরে দ্বিতীয় দফায় মোবাইলের সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে গ্রাহকরা ফোনে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৬৭ টাকার সেবা পাবেন, বাকি টাকা ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক হিসাবে কেটে নেওয়া হবে।

আরও যেসব খাতে খরচ বাড়তে পারে

রাজস্ব আদায় বাড়াতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দিকেও নজর দিয়েছে এনবিআর। সরবরাহ পর্যায়ে ওষুধের ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে সব ধরনের ওষুধের দাম বাড়বে। বাসা-বাড়িতে এলপিজি গ্যাসের দামও বাড়বে। কারণ এলপিজি গ্যাস সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়াও আরও দাম বাড়বে যেসব পণ্যের, সেগুলো হচ্ছে-গুঁড়া দুধ, বিস্কুট, আচার, টমেটো সস, এইচআর কয়েল, সিআর কয়েল, চশমার ফ্রেম, সানগ্লাস, টয়লেট টিস্যু, মিষ্টি, ব্র্যান্ডের তৈরি পোশাক, গাড়ির ওয়ার্কশপ, তাজা-শুকনা সুপারি, ফলের রস, তাজা ফল, সাবান-ডিটারজেন্ট, রং এবং সিগারেট। সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের নির্বাহী পরিচালক ড. মাশরুর রিয়াজ যুগান্তরকে বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর চাইতে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আইএমএফের পরামর্শে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে করহার পরিবর্তন করা উচিত হবে না, বিশেষত ভ্যাট হার। এমনিতে মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশের উপরে আছে। এনবিআর চাল, তেল, চিনি আমদানির শুল্ক কমিয়েও সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এই অবস্থায় ভ্যাট হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে নিশ্চিতভাবেই। এক্ষেত্রে ঋণের শর্তের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আইএমএফের সঙ্গে আরও শক্তভাবে দরকষাকষি করা উচিত ছিল।

এই বিষয়ে এনবিআরের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আইএমএফ এর শর্ত পূরণে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট খাতে বড় পরিবর্তনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মূলত আইএমএফ অর্থ বিভাগকে শর্ত দিয়েছে। অর্থ বিভাগ আমাদেরকে (এনবিআর) পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে বলেছেন। আইএমএফ এর শর্তানুযায়ী, ভ্যাট খাতে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়তি আদায় করতে হবে। অর্থাৎ বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় করতে হবে। আমরা কয়েকটি খাতে ভ্যাট বাড়ানো, কোথাও হ্রাস এবং কোথাও কোথাও যৌক্তিকীকরণের পরিকল্পনা প্রস্তাব প্রতিবেদন তৈরি করেছি। অর্থ উপদেষ্টাদের বৈঠকে প্রস্তাব প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেলে ৪ জানুয়ারি অধ্যাদেশ জারি হতে পারে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন পণ্যে বা সাধারণ মানুষের প্রভাব পড়ে এমন কোনো পণ্য বা সেবায় ভ্যাট বা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। বরং বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাজেটের পর বেশ কয়েকবার ভ্যাট ও শুল্ক কমানো হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!