৬৫ টাকায় পাঞ্জাবি, ৪০ টাকায় থ্রি-পিস আমদানি

উন্নতমানের ভারতীয় থ্রি-পিসের দাম মাত্র ৪৮ টাকা, আর সাধারণ মানের মাত্র ৪০ টাকা। সালোয়ার-কামিজ হলে দাম আরও কম, মাত্র ১৮ টাকা। মেয়েদের ‘টপস’ মিলছে ১১ টাকায়, আর উন্নত মানের ভারতীয় শাড়ি মাত্র ৬০ টাকায়। সবচেয়ে দামি পোশাক লেহেঙ্গা, যার মূল্য ১০৫ টাকা, আর ‘গর্জিয়াস’ লেহেঙ্গার দাম মাত্র ১২০ টাকা। এ তো ছিল মেয়েদের পোশাকের দাম, ছেলেদের পোশাকের দামও একইরকম। পাকিস্তানি পাঞ্জাবির দাম মাত্র ৬৫ টাকা, আর শিশুদের ভারতীয় পাঞ্জাবি মিলছে মাত্র ২৯ টাকায়। শুনে অবাক লাগলেও, ক্রেতাদের এতে আনন্দের কিছু নেই। কারণ, এই দাম শুধুই কাগজে-কলমে। ভারত ও পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঠিক এই দামে পোশাক আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অ্যাসাইকুডা হতে আমদানির তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র উঠে এসেছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনের পর বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। ঈদ বাজারে বিক্রির জন্যই এসব পোশাক আমদানি করা হয়েছে। তবে ক্রেতাদের জন্য হতাশার খবর হলো, বাজারে এসব পোশাক কিনতে হলে আমদানি দামের তুলনায় অন্তত ৫০ থেকে ১০০ গুণ বেশি মূল্য দিতে হবে। যেমন, চট্টগ্রামের আফমি প্লাজায় পাকিস্তানি সাধারণ থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়, আর উন্নত মানের থ্রি-পিসের দাম ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, বাজারে বিদেশি পোশাকের উচ্চমূল্যের সঙ্গে আমদানি দামের কোনো মিল নেই।

এত কম দরে পোশাক আমদানির নজির তৈরি করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মেয়েদের পোশাক এনেছে ঢাকার ভাটারার ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এলিফ্যান্ট রোডের এ আর ইন্টারন্যাশনাল ও পান্থপথের প্রতিষ্ঠান এভার গ্লোবাল। ছেলেদের পাকিস্তানের পাঞ্জাবির রেকর্ডটা নিজেদের করে রেখেছে ঢাকার খিলক্ষেতের অনয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। বাচ্চাদের পাঞ্জাবির রেকর্ডটা ঢাকার নিউমার্কেটের সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের। এ রকম বহু আমদানিকারকের নাম আছে তালিকায়।

পাকিস্তান থেকে অনয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ১৬ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৬৫ টাকায় প্রতি পিস পাঞ্জাবি আমদানি করেছে। অবশ্য এই দর অবিশ্বাস্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছেই। এ জন্য ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৬১০ টাকা মূল্য ধরে শুল্কায়ন করেছে। তাতে প্রতি পিসে ৬২২ টাকা শুল্ক–কর আদায় করেছে কাস্টমস। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি এক থেকে দুই ডলারে মেয়েদের থ্রি-পিস আমদানি করেছে প্রায় ৭০ হাজার পিস।

এ বিষয়ে অনয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোন না ধরায় প্রতিষ্ঠানের কারও মতামত জানা যায়নি। পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া পণ্য খালাসকারী এজেন্টদের একজন মনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার গাজী জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এত কম দরে কীভাবে পোশাক আমদানি হয়, তা আমারও মাথায় ঢোকে না। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ঠিকই নির্ধারিত মূল্যে শুল্কায়ন করে। মূলত ভারত ও পাকিস্তান—এই দুই দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে মূল্য কম দেখানো হয় বলে তিনি জানান। একই অবস্থা ভারত থেকে পোশাক আমদানিতেও। যেমন এলিফ্যান্ট রোডের এ আর ইন্টারন্যাশনাল গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৪০ টাকা দরে থ্রি-পিস আমদানি করেছে। পান্থপথের গ্রিনরোডের এভার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান অবশ্য ৪৮ টাকায় ৩৩ পিস উন্নত মানের থ্রি-পিস আমদানি করেছে। কাস্টমস ৪৮ টাকার থ্রি-পিসের মূল্য ১ হাজার ৪৬৪ টাকা ধরে শুল্কায়ন করেছে।

একই প্রতিষ্ঠান ১০৫ টাকা দরে সাধারণ লেহেঙ্গা আমদানি করেছে ভারত থেকে। গর্জিয়াস লেহেঙ্গা আমদানি করেছে ১২০ টাকায়। অবশ্য ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই দুই ধরনের পোশাকের শুল্কায়ন করেছে যথাক্রমে ৩ হাজার ৫০ টাকা ও ৫ হাজার ৪০০ টাকা দরে।শুধু থ্রি-পিসই নয়, এভার গ্লোবাল ৬০ টাকায় উন্নত ও মধ্যম মানের শাড়ি আমদানির রেকর্ড গড়েছে। গত জানুয়ারিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে তারা এই দরে শাড়ি এনেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই শাড়ি ১ হাজার ৮০০ টাকা দাম ধরে শুল্কায়ন করেছে। আবার বেনাপোল বাজারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্স বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৩০০ পিস টপস আমদানি করেছে। প্রতিটি টপসের দাম পড়েছে ১১ টাকার কম।

অ্যাসাইকুডার তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তান থেকে প্রায় সাড়ে ৩২ লাখ পিস পোশাক আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ টাকার কম দামে আমদানি হয়েছে প্রায় সোয়া ৮ লাখ পিস পোশাক। এছাড়া, ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে আমদানি করা হয়েছে অন্তত সোয়া ১০ লাখ পিস পোশাক। ২০১ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে দাম দেখিয়ে এসেছে আরও ৬ লাখ ৮৩ হাজার পিস পোশাক। অর্থাৎ, বাস্তবসম্মত মূল্যে আমদানি হওয়া পোশাকের সংখ্যা হাতেগোনা।

পোশাকের মূল্যের এত কম দরের নেপথ্যের কারণ আমদানিতে উচ্চশুল্ক। এই শুল্ক ফাঁকি দিতে পোশাকের দরের এমন তথ্যের সপক্ষে রপ্তানিকারকের ‘সনদ’ বা ইনভয়েসও রয়েছে আমদানিকারকদের। আমদানি-রপ্তানিকারক, এই দুই পক্ষের এমন বোঝাপড়ার সনদ সবাই বিশ্বাস করলেও কাস্টমস কর্মকর্তারা করেননি। আমদানিকারকদের ফাঁকির বিষয়টি তাঁরা অবগত। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি দাম ধরে শুল্কায়ন করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। ট্যারিফ কমিশন ১০ মার্চ এক প্রতিবেদনে দেশি শিল্পকে সুরক্ষা এবং রাজস্ব বাড়াতে শুল্কমূল্য বিধিমালা অনুসারে অর্থাৎ পোশাকের যাতে প্রকৃত বিনিময়মূল্য প্রতিফলিত হয়, সেভাবে শুল্কায়ন করার জন্য সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে পোশাকের চালান যথাযথভাবে যাচাই করারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ছয়টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাক আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই আসছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। এই বিমানবন্দর দিয়ে আনা পণ্য শুল্কায়ন করে ঢাকা কাস্টমস। জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমসের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা অনুসারে পোশাকের চালান শুল্কায়ন হচ্ছে। এরপরও আমরা ধীরে ধীরে প্রকৃত মূল‍্যে শুল্কায়নের প্রক্রিয়ায় আছি।’

ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পোশাকের শুল্কায়ন মূল্য অবিশ্বাস্য। তার মতে, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডার ইনভয়েসিং (কম মূল্য ঘোষণা) চলছে, যার ফলে বিপুল পরিমাণ পোশাক এসব দেশ থেকে বাংলাদেশে আসছে। তিনি আরও বলেন, দেশি পোশাক ব্যবসায়ীরা এখন অসম প্রতিযোগিতার মুখে। একদিকে বৈধপথে আমদানিকৃত পোশাকের মূল্য কম দেখিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ পোশাক দেশে আসছে। এ অবস্থায় আমদানি পোশাকের বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা দরকার। একই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলোরও দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে আমদানি পোশাকের মূল্য যথাযথভাবে ঘোষণা করা হয়। অন্যথায়, দেশীয় ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!