বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪ অনুসারে, দেশে সহিংসতার শিকার নারীদের প্রায় ৬৪ শতাংশ তাদের অভিজ্ঞতার কথা কাউকে কখনো বলেননি। পরিবারের সুনাম রক্ষা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ এবং সহিংসতাকে স্বাভাবিক মনে করার প্রবণতার কারণে এই নীরবতা প্রকাশ পায়। জরিপের ফলাফল ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়।
জরিপ বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে। দরিদ্রতাসহ নানা কারণে সব সময় শহরের চেয়ে নারী নির্যাতনের হার বেশি থাকে গ্রামে। কিন্তু সেই চিত্রেরও পরিবর্তন হয়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছলতা এলেও কমেনি নারী নির্যাতন।
বিবিএস ও ইউএনএফপিএ-এর তথ্য অনুযায়ী, যদিও নারীরা আয় করেন, কিন্তু তাদের উপার্জনে কর্তৃত্ব থাকে পুরুষের। শহর এবং গ্রামে নারী নির্যাতনের হার বাড়ছে। দেশে জাতীয়ভাবে জীবনে একবার হলেও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৭৫.৯ শতাংশ নারী। শহরে এই হার ৭৫.৬ শতাংশ, আর গ্রামে ৭৬ শতাংশ। শারীরিক, যৌন, মানসিক, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার মিশ্রণে ৭৫.৯ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল বাংলাদেশের সমন্বয়ে প্রকাশিত নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ-২০২৪ এর মূল ফলাফল উপস্থাপন করেন বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক ইফতেখারুল করিম। জরিপটি তৈরিতে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে দেশের ২৭ হাজার ৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। সময়কাল ছিল ২১ দিন।
গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমানতালে থাকা প্রসঙ্গে প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখারুল করিম বলেন, ‘শহরায়নের ফলে গ্রাম ও শহরে নারী নির্যাতনের হার সমান। নারী নির্যাতনের ধরনও পাল্টেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নারী নির্যাতন বাড়ছে। নানা ডিভাইসের মাধ্যমে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত ছবি বা অযাচিত অন্তরঙ্গ মেসেজ আদান-প্রদানের মাধ্যমে বাড়ছে নারী নির্যাতন। অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবেও নারী নির্যাতন করা হচ্ছে।’
আর্থিকভাবে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।’অনেক সচ্ছল স্বামী নারীর প্রয়োজন অনুসারে হাত খরচ দেন না। স্ত্রী চাইলো পাঁচ হাজার, দেওয়া হলো এক হাজার। এছাড়া নারী আয় করলেও টাকা খরচের দায়িত্ব থাকে স্বামীর হাতে। ফলে আর্থিকভাবে নারীরা এক ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ‘সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী কিন্তু নীরব থাকেন। সমাজের ভয়ে, পরিবারের কথা চিন্তা করে বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে তারা কথা বলেন না।’
যৌন নির্যাতন বেশি বরিশালে
জরিপে দেখা যায়, বরিশাল বিভাগে যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি, ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশ। বরিশালের পরেই যৌন নির্যাতন বেশি হয় চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪ দশমিক ১ শতাংশ। এছাড়া খুলনায় ২৯ দশমিক ৯, ঢাকায় ২৭ দশমিক ৮, রাজশাহীতে ২৭ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ২৩ শতাংশ, রংপুরে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও সিলেটে যৌন নির্যাতনের হার ২৮ দশমিক ২ শতাংশ।
শহর ও গ্রাম পার্থক্য কম
শহর ও গ্রামে যৌন নির্যাতনের হারে খুব বেশি পার্থক্য নেই। শহরে যৌন নির্যাতনের হার ৩১ দশমিক ১ এবং গ্রামে ২৮ শতাংশ। গত ১২ মাসেও যৌন নির্যাতন বেশি হয়েছে বরিশালে। এসময় জাতীয় পর্যায়ে দেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। সেখানে বরিশালে এর হার ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরেই চট্টগ্রামে ১১ দশমিক ২ শতাংশ।
এছাড়া ঢাকায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, খুলনায় ৯ দশমিক ১ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, রংপুরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিলেটে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত ১২ মাসে গ্রামে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ এবং শহরে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন ৬৪ শতাংশ নারী
জরিপ বলছে, মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন ৬৪ শতাংশ নারী। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানা বলেন, ‘এটা নানা কারণে হতে পারে। পার্টনার ভায়োলেন্সে নির্যাতনের বিষয়ে না বলার জন্য সামাজিক বাস্তবতা আছে। স্বামী সংঘটিত নির্যাতন অনেক সময় নারী চেপে রাখে সামাজিক বাস্তবতার কারণে।’তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে সিঙ্গেল নারী হিসেবে টিকে থাকা কিন্তু খুবই চ্যালেঞ্জিং। ফলে সংসার, সন্তান লালন-পালন করা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারী অনেকাংশে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। সমাজে ডিভোর্সড নারীকে ভালো চোখে দেখা হয় না।’
আর্থিকভাবে ও ডিভাইসে নারী নির্যাতন প্রসঙ্গে ড. উম্মে বুশরা বলেন, ‘ডিভাইসের অ্যাকসেস সমাজে অনেক দিন হলো। নারীর হাতে মোবাইল ডিভাইস থাকলেও নিয়ন্ত্রণ থাকে পুরুষের হাতে। নারী কীভাবে ব্যবহার করবে তা পুরুষ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটালি পুরুষ সব কিছু কন্ট্রোল করছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নারী নানা ধরনের অনলাইন ব্যবসা করেন। ফলে পণ্যের প্রমোশনে নারী লাইভে আসেন। আপনারা এসব কমেন্ট পড়লে দেখবেন অনেক নারী সাইবার অ্যাবিউজের শিকার হচ্ছেন।’
নারী নির্যাতনের শীর্ষে স্বামী
বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই জীবনসঙ্গী বা স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হন, যা একজন নারীর জীবনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জরিপে দেখা যায়, দেশের ৭০ শতাংশ নারী অন্তত একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন। যেখানে গত ১২ মাসে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪১ শতাংশ নারী।
জরিপটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সহিংসতার ঝুঁকির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তারতম্য, যেমন- দুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারী এবং বিগত ১২ মাসের মধ্যে অদুর্যোগপ্রবণ এলাকার নারীদের তুলনায় জীবনসঙ্গী বা স্বামীর দ্বারা বেশি মাত্রায় সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন।
সঙ্গী নন এমন ব্যক্তির মাধ্যমে নারী নির্যাতন বেশি ঢাকায়
সঙ্গী নন (নন-পার্টনার) এমন ব্যক্তির মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। শহরে এই হার ১৭ দশমিক ৩, যা গ্রামে ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ, শহরের নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।ঢাকায় এই নির্যাতনের হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপরই রয়েছে চট্টগ্রাম। সেখানে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ নারী নন-পার্টনারের মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন।
জরিপে বলা হয়, ‘নন-পার্টনার’ শব্দটি এমন যে কোনো ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা হয় যাকে সেই দেশ বা প্রেক্ষাপটে ‘সঙ্গী’ বলতে যেভাবে বোঝায় সে অনুযায়ী ‘সঙ্গী’ বলে মনে করা হয় না। নন পার্টনার বলতে তাই বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পরিচিত ও অপরিচিতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নারী নির্যাতন কমাতে সবার আগে মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। নারী নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত সমন্বিত হওয়ার দরকার বলে মত দিয়েছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মমতাজ আহমেদ বলেন, ‘সবার আগে আমাদের মাইন্ডসেট করতে হবে। তবেই কমবে নারী নির্যাতন। নারী নির্যাতন রোধে আমার মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সমন্বিত রিপোর্ট নেই। এগুলো সমন্বিত হওয়া দরকার। আমি কেবিনেটেও এটা নিয়ে কথা বলেছি। নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারি না। পুলিশ এক রকম দিচ্ছে, হেলথ এক রকম দিচ্ছে। তাহলে আমরা কী করবো?’
সময়ের পরিবর্তনের সাথে নারী নির্যাতন কমে যাওয়ার আশা প্রকাশ করে সিনিয়র সচিব বলেন, আমরা অনেক সময় চাই যে স্বামী সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করুক, এবং বাবা-মায়েরা ছেলেদের ওপর নির্ভর করে থাকেন। তবে প্রথমে আমাদের মনের ধরণ পরিবর্তন করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে এবং স্কুল কারিকুলামে এটি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আশা করি, সময়ের সঙ্গে আমরা পরিবর্তিত হবো এবং একদিন এমন একটি সমাজ পাবো যেখানে নারী নির্যাতন আর থাকবে না।