৬০০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন

প্রিমিয়ার ব্যাংক

বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছে। পাশাপাশি তারা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) না রাখার বিষয়টিও আড়াল করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এসব ভয়াবহ জালিয়াতি উদঘাটিত হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মতে, প্রতিটি ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্তের আগে প্রধান কার্যালয় ও বড় শাখাগুলোর খেলাপি ঋণ ও প্রভিশনের তথ্য যাচাই করা হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন চূড়ান্তের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধি দল সরেজমিন কয়েকটি শাখার অফসাইট রিপোর্টের ভিত্তিতে পর্যালোচনা চালায়। এতে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখিয়েছে এক হাজার ৬১১ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত খেলাপি ঋণ ছিল সাত হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ গোপন করা হয়, যা পরিদর্শন দলের প্রতিবেদন ও ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টে ধরা পড়ে।

পাশাপাশি, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে জানিয়েছে ৭৮৫ কোটি টাকা প্রভিশন উদ্বৃত্ত রয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিয়মিত ঋণ ও খেলাপি ঋণের ভিত্তিতে ডিসেম্বর শেষে প্রভিশন রাখা উচিত ছিল ছয় হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। ব্যাংক রাখতে পেরেছে মাত্র এক হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রভিশনে ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও তারা তা প্রকাশ করেনি এবং উল্টো ৭৮৫ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত দেখিয়েছে। ফলে পাঁচ হাজার ৪৩১ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির তথ্য আড়াল করা হয়েছে। ডিসেম্বরভিত্তিক প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংক এক বছরের জন্য ডেফারেল সুবিধা (অতিরিক্ত সময় বা বিলম্বের অনুমতি) গ্রহণ করেছে।

গত পাঁচ বছরের খেলাপি ঋণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালেই ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০২৩ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল এক হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা, যা ওই সময়ের বিতরণ করা ঋণের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ২০২২ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৭৬৭ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২১ সালে ছিল ৬৮১ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ৫৩৫ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৫১ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা যায়, প্রিমিয়ার ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখার বিশাল অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে। এসব ঋণ এতদিন ব্যাংক লুকিয়ে রেখেছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন কিছু না বললেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পর এসব ঋণ খেলাপি করতে নির্দেশ দেয়। যদিও ব্যাংক এসব ঋণ খেলাপি করতে নারাজ ছিল। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে খেলাপি করতে বাধ্য হয় ব্যাংক। ফলে হঠাৎ করে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জ শাখার ঋণগুলো খেলাপি হিসেবে ঘোষণা করার নির্দেশ থাকলেও ব্যাংক তা মানতে রাজি ছিল না। ফলে ব্যাংক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেনি। কোম্পানি আইন অনুযায়ী, পরবর্তী বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে হয়। তবে এবার অনেক ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে নিরীক্ষিত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে না পারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক মাসের ছুটি দিয়েছে। সেই সময়সীমা শেষ হয় ৩১ মে। তবুও প্রিমিয়ার ব্যাংক সময়মতো প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারেনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটিকে জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং চলতি মাসে ঋণগুলো খেলাপি হিসেবে দেখিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে গত বছর ব্যাংকের মুনাফাও কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ব্যাংকের নিট মুনাফা হয় ১৪৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে মুনাফা হয়েছিল ৪৩৪ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে মুনাফা ২৮৯ কোটি টাকা কমেছে। ২০২২ সালে নিট মুনাফা ছিল ৪০৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ৩২৬ কোটি এবং ২০২০ সালে ২০৬ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালে সবচেয়ে কম মুনাফা হয়।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, প্রভিশন এবং মূলধন ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাস শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ রয়েছে ৮ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৫.৬২ শতাংশ। মার্চ শেষে ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ১৬ কোটি টাকায়। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতির প্রভাবে ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতেও পড়েছে। মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, যা জুনে বেড়ে ৭ হাজার ২৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করার বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু জাফরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। হোয়াটসঅ্যাপে বিস্তারিত বার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

** প্রিমিয়ার থেকে ২৮৭ কোটি তোলার চেষ্টা ইকবালের
** প্রিমিয়ার ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ হারাল ইকবাল পরিবার
** প্রিমিয়ার ব্যাংককে দেড় কোটি টাকা জরিমানা
** প্রিমিয়ার ব্যাংকে ভুয়া এলসিতে ১০২ কোটি আত্মসাৎ
** প্রিমিয়ার ব্যাংক ছাড়লেন ইকবাল ও তার ছেলে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!