৫৬৭ দোকানের ২৪১টির ভ্যাট নিবন্ধন নেই

রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা

** রংপুর, রাজশাহী ও খুলনার তিনটি মার্কেটে দোকান রয়েছে ৫৬৭, যার মধ্যে চালু রয়েছে ৫৩৩
** ৫৩৩ দোকানের মধ্যে ২৯২টি ভ্যাট নিবন্ধন আছে, আর ২৪১টি দোকানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই
** ভ্যাট নিবন্ধিত ২৯২টি দোকানের মধ্যে নিয়মিত অনলাইনে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল করে ৫৩টি

রাজশাহী, রংপুর ও খুলনার তিনটি শহরের প্রাণকেন্দ্রের তিনটি মার্কেট। মোবাইল ফোন, কাপড়, স্বর্ণ, জুয়েলারি, এক্সেসরিজ, জুতা, হোটেল, ইলেকট্রনিক্সস সামগ্রী, তৈরি পোশাক, ঘড়ি, ব্যাগ, কসমেটিকস, স্পোর্টস আইটেম, পার্লার ইত্যাদি দোকান রয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তিনটি মার্কেটের মোট ৫৬৭টি দোকানের মধ্যে চালু অবস্থায় রয়েছে ৫৩৩টি দোকান। আবার চালু থাকা ৫৩৩টি দোকানের মধ্যে মাত্র ২৯২টি দোকানের ভ্যাট বা মূসক নিবন্ধন আছে, বাকি ২৪১টি দোকানের মূসক নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন নেয়া ২৯২টি দোকানের মধ্যে মাত্র ৫৩টি নিয়মিত অনলাইনে মাসিক মূসক রিটার্ন (ভ্যাট রিটার্ন) দেয় মাত্র ৫৩টি। অর্থাৎ নিবন্ধন নেয়া ২৯২টি দোকানের মধ্যে ২৩৯টি দোকান ভ্যাট রিটার্ন দেয় না। মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (ভ্যাট গোয়েন্দা) জরিপে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সম্প্রতি ভ্যাট গোয়েন্দা থেকে এনবিআর চেয়ারম্যান পৃথক তিনটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাইরে জেলা ও বিভাগীয় শহরে প্রচুর মার্কেট ও শপিংমল গড়ে উঠেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ার ফলে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মার্কেট হচ্ছে। কোন কোন মার্কেট কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আবার কোন কোন মার্কেট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হলেও বেশ জাকজমকপূর্ণ। এসব মার্কেটে থাকা দোকান ও শো-রুমে প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। কিন্তু এসব মার্কেটের সব দোকান ও শো-রুমকে ভ্যাট নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে না। আবার নিবন্ধন নিলেও নিয়মিত রিটার্ন ও ভ্যাট দেয় না। ফলে সরকার প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এনবিআরকে দেশব্যাপী নিবন্ধনের বাইরে থাকা মার্কেটের দোকান ও শো-রুমকে দ্রুত নিবন্ধনের আওতায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এনবিআর সূত্রমতে, পৃথক তিনটি প্রতিবেদনে খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরের তিনটি মার্কেটে থাকা দোকানের ওপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দা বলছে, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ভ্যাট গোয়েন্দা তিনজন করে একটি টিম হিসেবে মোট তিনটি জরিপ টিম গঠন করে। তিনটি টিমের মধ্যে ১ জানুয়ারি একটি টিম ‘রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেট’, ৬ জানুয়ারি একটি টিম রাজশাহীর বোয়ালিয়ায় অবস্থিত ‘থিম ওমর প্লাজা’ ও ৯ জানুয়ারি একটি ‘খুলনা শপিং কমপ্লেক্সে’ জরিপ পরিচালনা করে। টিমের সদস্যরা জরিপ শেষে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

রংপুর ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন ‘রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেট’ এর করা জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কেটটি রংপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। জমজমাট তিনতলার এই মার্কেটে কাপড়, ব্যাগ, কমসমেটিকস, মোবাইল, খাবার, জুতা, ইলেকট্রনিকস আইটেম, জুয়েলারি, ঘড়ি, স্পোর্টস আইটেম, এক্সেসরিজ, পার্লার ইত্যাদির দোকান রয়েছে। এই মার্কেটে দোকান সংখ্যা ৩২০টি। যার মধ্যে নিচতলায় ১০০টি, দ্বিতীয় তলায় ১০৮টি ও তৃতীয় তলায় ১০৩টি দোকান রয়েছে। যার মধ্যে চালু অবস্থায় রয়েছে ৩১১টি। আইভাসের তথ্যানুযায়ী, মোট দোকানের মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১৮২, যা মোট খোলা দোকানের মধ্যে মাত্র ৫৮ দশমিক ৫২ শতাংশ। আবার মূসক নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ১৮২টি, যা খোলা দোকানের মধ্যে ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নিবন্ধিত ১৮২টি দোকানের মধ্যে মাত্র ১২টি দোকান মালিক নিয়মিত মাসিক রিটার্ন দাখিল করে। আবার ১৮২টি দোকানের বিপরীতে অনলাইনে মূসক রিটার্ন দাখিলের হার ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

রাজশাহী ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন ‘থিম ওমর প্লাজা’য় চালানো জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কেটটি রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। সাততলা এই মার্কেটে ঘড়ি, কাপড়, ব্যাগ, জুয়েলারি, কসমেটিকস, মোবাইল, খাবার, জুতা, ইলেকট্রনিকস আইটেম ইত্যাদির ১০৬টি দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৯৬টি দোকান চালু অবস্থায় পাওয়া গেছে। আইভাসের তথ্যানুযায়ী, ৯৬টি দোকানের মধ্যে মূসক নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৬৫টি, যা মোট খোলা দোকানের মধ্যে ৬৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। বাকি ৩১টি দোকানের নিবন্ধন নেই, যা খোলা দোকানের মধ্যে ৩২ দশমিক ২৯ শতাংশ। আবার ৬৫টি দোকানের মধ্যে ৩৮টি দোকান মূসক রিটার্ন দাখিল করে। নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে অনলাইনে রিটার্ন দাখিলের হার ৫৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

অপরদিকে, খুলনা ভ্যাট কমিশনারেটের আওতাধীন ‘খুলনা শপিং কমপ্লেক্সে’ চালানো জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মার্কেটটিতে চলন্ত সিঁড়ি, ভূগর্ভস্থ পার্কিং, কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। এই মার্কেটের মোট দোকান সংখ্যা ১৪১টি, যার মধ্যে চালু রয়েছে ১২৬টি। চার তলা মার্কেটটিতে কাপড়, তৈরি পোশাক, টেইলার্স, মোবাইল ফোন, এক্সেসরিজ ও সার্ভিসিং, মোবাইল অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার, জুয়েলার্স, কসমেটিকস ইত্যাদির দোকান রয়েছে। আইভাসের তথ্যানুযায়ী, চালু ১২৬টি দোকানের মধ্যে মূসক নিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৪৫টি, যা মোট খোলা দোকানের ৩৫ দশমিক ৭১ শতাংশ। মূসক অনিবন্ধিত দোকানের সংখ্যা ৮১টি, যা মোট খোলা দোকানের ৬৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। আবার নিবন্ধিত ৪৫টি দোকানের মধ্যে মাত্র তিনটি দোকান রিটার্ন দাখিল করে।

অপরদিকে, এনবিআরের ২০১৯ সালের এক আদেশে বলা হয়েছে, শপিংমলে অবস্থিত সকল প্রতিষ্ঠানকে মূসক বা ভ্যাট নিবন্ধন গ্রহণ করতে হবে। নিবন্ধন গ্রহণ না করার ফলে পণ্যের মূল্যের সাথে মূসক অন্তর্ভূক্ত থাকায় আদায় করা মূসকসহ মূল্য হতে সরকারের প্রাপ্য রাজস্ব কোষাগারে জমা হচ্ছে না। এতে অন্যান্য মার্কেটের সাথে অসম প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে।

অপরদিকে, তিনটি জরিপ প্রতিবেদনে মতামত দিয়েছেন জরিপকারী কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, নিবন্ধনহীন দোকান থেকে কোন ভ্যাট আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এসব মার্কেট থেকে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সরকারি রাজস্ব সুরক্ষার স্বার্থে শীঘ্রই এই তিন মার্কেটের মূসক আরোপযোগ্য অনিবন্ধিত দোকানকে সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট দ্রুত নিবন্ধনের আওতায় আনা ও মূসক রিটার্ন দাখিলের কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে।

এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে বহু ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে—যেগুলো এখনো নিবন্ধনের আওতায় আসেনি। বিশেষ করে হোটেল, সুপারশপ, শপিংমল। কৌশলে বহু প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন আওতার বাইরে রয়েছে। ফলে সরকার সঠিকভাবে ভ্যাট পায় না। দেশের সকল ভ্যাটযোগ্য প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে যাদের বার্ষিক টার্নওভার ভ্যাটযোগ্য, সুপারশপ, শপিংমলসহ সিটি করপোরেশন, জেলা-উপজেলা শহরের মার্কেট, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতায় আসেনি। নিবন্ধন আওতার বাইরে থাকা সব প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে নিবন্ধন মাস ঘোষণা করেছে এনবিআর। এতে ফেব্রুয়ারি মাস সব ভ্যাট কমিশনারদের নিবন্ধন মাস এবং মার্চ এনবিআরের ভ্যাট নিবন্ধন মাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। নিবন্ধিতহীন প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে ভ্যাট কমিশনারেটগুলো চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!