** ১,৬৫,৪৮৪.৯৯ মেট্রিক টন র সুগার শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে
** ৬ মাসে ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা এই কাঁচামাল অপসারণে বন্ডকে অবগত করা হয়নি
** আগে একইভাবে ৫ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন র সুগার অপসারণ করা হয়েছে, ব্যাংক হিসাব জব্দের পরেও তাতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি শুল্ককর পরিশোধ করা হয়নি
ছয় মাসে আমদানি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন র সুগার বা চিনির কাঁচামাল। বন্ড সুবিধায় আমদানি করা এই র সুগারের উপর প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫২০ কোটি টাকা। এসব সুগার শুল্ককর পরিশোধ করে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থেকে খালাস নেওয়ার কথা। কিন্তু বন্ড কমিশনারেটকে না জানিয়ে অবৈধভাবে এসব র সুগার বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। দেশের বৃহত্তম শিল্পগোষ্ঠী আব্দুল মোনেম এর আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেড এই র সুগার খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে ৪৯ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে বিচারাদেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (দক্ষিণ) এর কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন এই বিচারাদেশ দেন। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
অপরদিকে, আব্দুল মোনেম গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানটির র সুগার অবৈধ অপসারণ ও শুল্ককর ফাঁকি যেন থামছেই না। প্রতিষ্ঠানটি এর আগে প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন র সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। যাতে প্রায় ১ হাজার ২০৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা শুল্ককর ফাঁকি দিয়েছে। ফাঁকি প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠান ৫৩৩ কোটি টাকার শুল্ককর পরিশোধ করেছে। বাকি ৬৭৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকার শুল্ককর পরিশোধ না করায় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একইসঙ্গে আব্দুল মোনেম গ্রুপের সব প্রতিষ্ঠানের আমদানি-রপ্তানি স্থগিত, সুগারের উৎপাদন ও বাজারজাত স্থগিত করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠান কিছু শুল্ককর পরিশোধ করায় হিসাব সচল করা হয়। তবে সেখানেও প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশিরভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়নি বলে ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারেট সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে, সর্বশেষ বুধবার ঢাকা দক্ষিণ বন্ড কমিশনারের দেওয়া বিচারাদেশে বলা হয়েছে, আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেড হোম-কনজাম্পশন বন্ডভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান। কাস্টমস আইন অনুযায়ী, হোক-কনজাম্পশনভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমদানিকালে শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই র সুগার আমদানি করে বন্ড রেজিস্টারে ইন্টু-বন্ড করে বন্ডেড ওয়্যারহাউজে গুদামজাত করা হয়। এই র সুগারের বন্ডিং মেয়াদ ছয় মাস। বন্ডেড লাইসেন্স প্রদানের শর্তানুযায়ী এক্স-বন্ড ডিক্লারেশন করে আইন অনুযায়ী বন্ড সুবিধায় আমদানি করা র সুগারের প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ করে দেশীয় ভোগের জন্য খালাস নেওয়া হয়।
ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রমতে, আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেড বন্ড সুবিধায় আমদানি করা র সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ পায় বন্ড কমিশনারেট। এরই প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল কমিশনারেটের একটি প্রতিনিধি দল প্রতিষ্ঠান সরেজমিন পরিদর্শন করেন। এসময় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সহায়তায় ওয়্যারহাউজে মজুদ কাঁচামাল বা র সুগার ইনভেন্টি করা হয়। এতে দেখা হয়, বন্ডেড ওয়্যারহাউজে কোন র সুগার নেই। অথচ বন্ডেড হিসাব অনুযায়ী ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধায় ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার আমদানি করেছে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ১৬ আগস্ট পর্যন্ত এই র সুগার আমদানি করা হয়েছে। এই র সুগারের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ৯৭৮ কোটি ৭৯ লাখ ৫৬ হাজার ৮৯০ টাকা। যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর (কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট ও অগ্রিম কর) ৫২০ কোটি ৫৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫০ টাকা। প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তারা বন্ডেডওয়্যার হাউজে র সুগার মজুদ না থাকার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করা হলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এতে বন্ড কর্মকর্তাদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর ফাঁকি দিতে র সুগার অবৈধভাবে অপসারণ করে বিক্রি করে দিয়েছে। অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ করায় কাস্টমস আইনে বন্ড লাইসেন্সের শর্ত ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সি বিধিমালার বিধানসমূহ লংঘিত হয়েছে। ফলে প্রযোজ্য শুল্ককর ছাড়াও বন্ডিং মেয়াদ উর্ত্তীণের তারিখ হতে প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি দেওয়া শুল্ককরের উপর সুদ প্রযোজ্য হবে।
সূত্র আরও জানায়, অবৈধভাবে কাঁচামাল অপসারণ ও শুল্ককর ফাঁকি দেওয়ায় চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ১১ মে লিখিত জবাব দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়, বন্ড সুবিধায় আমদানি করা অপরিশোধিত চিনি গুদামজাত করা হয়। বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্তির পর থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে বন্ডিং সুবিধায় আমদানি করা সকল কাঁচামাল চলমান মামলা ও কারণ দর্শানো নোটিশের আওতাভুক্ত হয়েছে। ফলে কারণ দর্শানো নোটিশে উল্লিখিত ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার দেখানো হয়েছে। তাই অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডসহ যাবতীয় দলিলাদি সংগ্রহপূর্বক এ দপ্তর থেকে ইস্যু করা কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব তৈরি করা এবং র্দীঘদিনের পুঞ্জীভূত ওয়্যারহাউজের ইনভেন্টিরি যাচাই বাছাই প্রয়োজন। ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের সময় প্রয়োজন। নতুবা তাদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। নোটিশের জবাব ও ব্যক্তিগত শুনানিতে উপস্থিত হতে তাদের তিনমাস সময় প্রয়োজন। একই কারণ দেখিয়ে চলতি বছরের ২৩ জুন, ২৪ জুলাই ও ১৫ আগস্ট তিনবার সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হয়।
সর্বশেষ ২৩ সেপ্টেম্বর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হাসান ও হেড অব কমার্শিয়াল আজিজুর রহমান চৌধুরী শুনানিতে উপস্থিত হন। শুনানিতে উপস্থিত বন্ড কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিষ্ঠান ৬০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৮৪ দশমিক ৯৯ মেট্রিক টন র সুগার কোন প্রকার এক্স বন্ড ছাড়াই বা শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই বা শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ওয়্যারহাউজ থেকে খালাস করেছে। সংশ্লিষ্ট বন্ড কর্মকর্তাকে অবগত না করেই এই কাঁচামাল অপসারণ করা হয়েছে। অবৈধ অপসারণ করায় লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে, যাতে সুদসহ প্রযোজ্য শুল্ককর আদায়যোগ্য। তবে শুনানিতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে লিখিত জবাব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই কাঁচামাল অপসারণ করা হয়েছে। তারা দণ্ডারোপ না করার অনুরোধ জানান। তবে তারা আমদানি করা এই সুগারের রেগুলেটরি ডিউটি কাস্টমস আইন অনুযায়ী যথাযথ নয় বলে প্রশ্ন তোলেন। তারা কাস্টম হাউসে রেগুলেটরি ডিউটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম এর ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও জবাব দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বক্তব্যের বিষয় লিখে দেওয়া হলেও তিনি জবাব দেননি। একই বক্তব্য জানতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী নাজমুল হাসানের ব্যক্তিগত নাম্বারে ফোন করা হয়। তিনি মিটিংয়ে রয়েছে বলে খুদে বার্তা পাঠানো হয়। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার হয়ে প্রতিষ্ঠানের হেড অব কমার্শিয়াল আজিজুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা বন্ড কমিশনারেটকে রেগুলেটরি ডিউটি হিসাব করার জন্য বলেছি। আমাদের হিসাবে আমরা সরকার রেগুলেটরি ডিউটি হিসেবে অনেক টাকা পরিশোধ করেছি, যা আমাদেরকে এখন যে ডিমান্ড করা হয়েছে—তার চেয়ে অনেক বেশি। কমিশনারেট কোন হিসাব না করেই বিচারাদেশ দিয়েছে। আগের ১২০০ কোটি টাকার শুল্ককর বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি। বাকি টাকা আমাদের কিস্তি করে দিয়েছে। ব্যবসার অবস্থান ভালো নয়। সেজন্য বিলম্ব হচ্ছে।
***