‘৫জি’ সেবার নামে লুটপাটই ছিল মূল লক্ষ্য

দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র প্রতিষ্ঠান টেলিটক দীর্ঘদিন ধরেই নানা সংকটে জর্জরিত। একের পর এক উদ্যোগ নিলেও প্রতিষ্ঠানটি আজও সাফল্যের মুখ দেখেনি। ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘দিনবদলের স্বপ্ন’ দেখিয়ে টেলিটকের উন্নয়নে নেয় বিশাল বাজেটের একটি প্রকল্প—যার ব্যয় ধরা হয় ২,২৩৮ কোটি টাকা। তবে সময় গড়ালেও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না।বারবার প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হলেও এখনও তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। ফলে সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থ যেমন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে, তেমনি গ্রাহকসেবাও রয়েছে হতাশাজনক অবস্থায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি শুধু ব্যর্থতা নয়, বরং আগের সরকারের নানা খাতে দুর্নীতির একটি প্রতীক। এখন এই প্রকল্পটি অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য রীতিমতো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানা যায়, আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক নিশ্চিতে ‘গ্রাম পর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ৫জি সেবা প্রদানে নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন’ প্রকল্পটি হাতে নেয় তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। চালানো হয় ব্যাপক-প্রচারণা। আর তলে তলে চলতে থাকে লুটপাটের ছক। শুরু থেকেই অনিয়ম-দুর্নীতি চলতে থাকে এই প্রকল্পে। যা থেমে নেই এখনো! অস্বাভাবিক ব্যয় ও সময়ের কারচুপিতে মুখ থুবড়ে পড়ে প্রকল্পের সফলতা। এই প্রকল্পটির সবচেয়ে বড় শুভঙ্করের ফাঁকিটি হলো ‘৫জি’ সেবা। পত্রিকা-টেলিভিশনের প্রচারণা ও প্রকল্প ডকুমেন্টে ‘৫জি’ সেবার কথা বলা হলেও পুরো আয়োজন চলছে ‘৪জি’র।

প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ছিল দুই হাজার ২০৪ কোটি টাকা। প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ২৩৮ কোটি টাকার বেশি। ২০২১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি। ব্যয় না বাড়িয়ে সবশেষ বাস্তবায়ন কাল ধরা হয় চলতি বছরের জুনে। তবে জুনেও শেষ হচ্ছে না কাজ। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবনা। যেখানে প্রকল্পটির মেয়াদ জুন ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্পটির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের অনুমোদনসংক্রান্ত প্রশাসনিক আদেশ ৩ অক্টোবর ২০২১ সনে জারি হলেও প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ হয়েছে ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি। ছয় মাস দেরিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের সমাপ্তির জন্য চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রায় এক হাজার ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৮০ কোটি টাকা। এছাড়া প্রকল্পটি শেষ করতে আরও এক হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে, শুধু ব্যয় বৃদ্ধিই নয়; কেনাকাটায় অস্বাভাবিক ব্যয় ও অনিয়মের অভিযোগও যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তথ্যের সূক্ষ্ম কারচুপি ও শুভঙ্করের ফাঁকি!খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের মোবাইল টাওয়ার অপারেটর ৪৮ ভোল্ট ১০০ অ্যাম্পিয়ারের লিথিয়াম ব্যাটারি কেনে। যার বাজারদর ৭৪ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে। অথচ সরকারের এই প্রকল্পে এই ব্যাটারি কেনা হচ্ছে এক লাখ সাত হাজার টাকা দরে। এই ব্যাটারি কিনতেই সরকারের খরচ হচ্ছে ৫৪ কোটি ৭৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। একটি ব্যাটারিতেই ২৭ থেকে ৩০ হাজার টাকা লুট করা হচ্ছে। মোট এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা লুট হচ্ছে শুধু ব্যাটারিতেই।

লিথিয়াম ব্যাটারি নিয়ে কাজ করা একটি আমদানি কোম্পানির বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমাদের দেশে টেলিযোগাযোগে ‘বি-গ্রেডের’ ব্যাটরি ব্যবহার হয়। সেখানে ব্যাটারির দাম ৭২ হাজার থেকে ৭৪ হাজার টাকা হয়ে থাকে। একসঙ্গে অনেক নিলে দাম আরও কমে। আর এ গ্রেডের ব্যাটারির দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা হবে। এর বেশি কখনোই না।

এই প্রকল্পে ১২ হাজার ৫০০ এন্টেনার জন্য ব্যয় ৭২ কোটি ৪৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা। যেখানে প্রতিটি এন্টেনার দাম পড়ছে ৫৭ হাজার ৯৯২ টাকা। আবার এন্টেনার আরেক কলামে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। যেখানে ছয় হাজার ৫০০ এন্টেনায় প্রতিটিতে ব্যয় ৪৩ হাজার ৪৬১ টাকা। জেনেটার স্থাপনে নয় কোটি ১৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকার ব্যয় ধরা হয়েছে। ৯৬টি জেনেটারে প্রতিটির খরচ ধরা হয়েছে সাড়ে নয় লাখ টাকারও বেশি! যা বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফোরজি সিপি ডিভাইস কিনতে প্রতিটি ১৫ হাজার ২৮০ টাকা দরে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সাত কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এছাড়া এই প্রকল্পের সর্বাধিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাপ্লাই ইন্সটুমেন্টে। যার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাবতায়।

প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘আমি এটার অতিরিক্ত দায়িত্বে আছি গত ২৩ অক্টোবর থেকে। এই প্রকল্পের সব তথ্য আমি জানি না। তবে যেটুকু দেখিছি, সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি আছে বলে মনে হয়নি।’‘৪জি’ ইনোডবি দিয়ে ‘৫জি’ সেবা সম্ভব কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা ‘৫জি’ সেবা প্রদানের প্রকল্প না। এটা ‘৪জি’র। ‘৫জি’র জন্য প্রস্তুতি পর্ব। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’

এদিকে, এই প্রকল্পের এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৯৪ কোটি ১২ লাখ টাকার কাজ হলেও এর ন্যূনতম সুফল পৌঁছায়নি গ্রাহকের কাছে। সরকারি চাকরি আবেদনের ফি পরিশোধ ছাড়া টেলিটক সিম অন্য কোনো কাজেই লাগছে না বলে জানিয়েছেন অনেক গ্রাহক। রাজশাহীর পবা উপজেলার বাসিন্দা ইয়াসিন আলী বলেন, ‘টেলিটক সিম কিনেছি চাকরির আবেদনের ফি জমার দেওয়ার জন্য। এরপর বেশ কয়েকবার যে সামান্য রিচার্জ করেছি, তা দিয়ে কথাও বলা যায় না।’

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আরও বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য পাওয়া যায়। তারাও বলছেন, টেলিটক প্রথমে অনেক আশা নিয়ে কিনলেও এখন তা তেমন কোনো কাজে লাগছে না। আশপাশের কেউ চাকরির আবেদন করলে ফি পরিশোধের জন্য সিম ধার নেয় বলেও জানান তারা।

**টেলিটক-হুয়াওয়ে প্রকল্প: ঘুষ লেনদেন ২০ কোটি টাকা

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!