সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নেতৃত্বাধীন সূচনা ফাউন্ডেশনের ১৪টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছিল ৫৩১ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা। তবে আয়কর নথি অনুযায়ী, ফাউন্ডেশনটি আয় দেখিয়েছে মাত্র ৯০ কোটি ২৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা এবং ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৭ কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ফলে আয়কর নথিতে ৪৪৭ কোটি ৯৫ লাখ ১০ হাজার টাকার কোনো তথ্য উল্লেখ নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দুদক মনে করছে, এই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শিগগির অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হবে।অটিজম নিয়ে সচেতনতা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে সূচনা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। দুদকের অনুসন্ধান বলছে, এসব ক্ষেত্রে এই অর্থ খরচের তথ্য পাওয়া যায়নি। এই টাকা প্রতিষ্ঠানটির অন্য কোনো খাতে বা ব্যক্তিগত কোনো খাতে বিনিয়োগও করা হয়নি।
দুদকের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র মো. আক্তার হোসেন বলেন, অনুসন্ধান টিম ইতোমধ্যে তাদের কাজ শেষ করেছে। অনুসন্ধানে অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ আমলযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিশনের অনুমোদনের জন্য শিগগির প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা শুরু করা হবে।
দুদকের অনুসন্ধান দল খসড়া প্রতিবেদনে বলেছে, ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে যে ৫৩১ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা জমা হয়েছে, তা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে। উত্তোলন করা হয়েছে ৪৬৫ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১৪টি হিসাবে স্থিতি আছে ৬৬ কোটি ৪৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ইস্টার্ন, সোনালী, ট্রাস্ট ও জনতা ব্যাংকের সিএসআরের টাকা এবং ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ২৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনকে দিয়েছে। ১৪টি হিসাবের মধ্যে ছয়টি এফডিআর ও আটটি সঞ্চয়ী হিসাব।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে সূচনা ফাউন্ডেশনের নিবন্ধন নেওয়া হয় ২০১৪ সালের ১২ জুন। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি দুদক রাজধানীর ধানমন্ডির পুরাতন ৫ নম্বর রোডের ৫৪ নম্বর সুধা সদনে যায়। কিন্তু সেখানে ফাউন্ডেশনের অফিসের কোনো অস্তিত্ব পায়নি। এই বাড়িটিতে একসময় শেখ হাসিনা থাকতেন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এই বাড়িটিতেও হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। বতর্মানে তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন।
যে ১৪ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সূচনা ফাউন্ডেশনে অনুদানের নামে ২৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা দিয়েছেন ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। দুদকের ধারণা, এসব অর্থ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংগ্রহ করা হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, বে গ্রুপ (ফুটওয়্যার লিমিটেড) দিয়েছে সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা। সামিট গ্রুপ (অয়েল ও শিপিং কোম্পানি লিমিটেড) দিয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ, ইউনাইটেড গ্রুপ ২ কোটি, প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ২ কোটি ২১ লাখ, বেক্সিমকো হোল্ডিংস ১ কোটি ৬০ লাখ, কনফিডেন্স গ্রুপ (পাওয়ার লিমিটেড) ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়েছে।
বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ও রিজলিং অ্যাসোসিয়েটস দিয়েছে ১ কোটি টাকা করে। এছাড়া মেঘনা গ্রুপ (সোনারগাঁও সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ), বঙ্গ গ্রুপ, চ্যানেল-৯, সানোয়ারা ডেইরি ফুডস লিমিটেড এবং এ কে এম রহমাতুল্লাহ দিয়েছেন ৫০ লাখ করে টাকা। হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড দিয়েছে ৩৮ লাখ টাকা।
অভিযুক্ত ১১ জন
দুদক প্রাথমিক তদন্তে সূচনা ফাউন্ডেশনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সায়মা ওয়াজেদ, চেয়ারপারসন ও ট্রাস্টি প্রফেসর ডা. মাজহারুল মান্নান, ট্রাস্টি মো. নাজমুল হাসান পাপন, সায়ফুল্লাহ আবদুল্লা সোলেনখী, জ্যান বারী রিজভী, কোষাধ্যক্ষ মো. শামসুজ্জামান, ভাইস চেয়ারপারসন প্রফেসর প্রাণ গোপাল দত্ত, নির্বাহী কমিটির সদস্য প্রফেসর ডা. আ ফ ম রুহুল হক, শিরিন জামান মুনির, এম এস মেহরাজ জাহান এবং ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।কমিশনের মতে, সেবামূলক কার্যক্রমের আড়ালে সূচনা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে একাধিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান দল
দুদকের সাত সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান দলের সদস্যরা হলেন– দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া, মুবাশ্বিরা আতিয়া তমা, এস এম রাশেদুল হাসান, কে এম মুর্তুজা আলী সাগর, মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ও উপসহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন। অনুসন্ধান কার্যক্রমের তদারককারী কর্মকর্তা দুদক পরিচালক ড. খান মো. মীজানুল ইসলাম।