শুল্ককর দেয়নি আদানি: অনিয়ম অনুসন্ধানে কমিটি

৩ হাজার কোটি টাকা ফাঁকি

ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে শুল্ককর সংক্রান্ত বিষয়গুলো কীভাবে সম্পাদন করা হয়েছে, তাতে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, শুল্ক পরিহার বা প্রত্যাহারের বিষয় রয়েছে কি না-এসব অনিয়ম অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক এদিপ বিল্লাহর সমন্বয়ে (আহ্বায়ক) আট সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশে বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফখরুল আলম এই কমিটি গঠন করেছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-উপ-পরিচালক মুনমুন আকতার দিনা, রাজস্ব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক ভূঁইয়া, পলাশ কুমার মল্লিক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান, মো. আবুল কাশেম, মো. সাহেদ হাসান লিমন। কমিটির সদস্য সচিব হলেন-কাস্টমস গোয়েন্দার উপ-পরিচালক মো. মিজানুর রহমান।

** ২০১৭ সালে আদানির সঙ্গে চুক্তিতে এনবিআরের অনুমতি ছাড়াই শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হয়
** বিদ্যুৎ আমদানির ওপর ৩১.০৭% শুল্ক-কর রয়েছে, যা পরিশোধ ছাড়াই দেয়া হচ্ছে আদানির বিল
** অনুমতি ছাড়া কীভাবে শুল্ক-কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে—জানতে চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিয়েছে এনবিআর, তবে উত্তর দিচ্ছে না বিদ্যুৎ বিভাগ
** গত মার্চ পর্যন্ত আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হতো ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা পায়নি এনবিআর

এনবিআর সূত্রমতে, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে আদানির বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ৩১ শতাংশের বেশি শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হবে। তবে আদানির বিদ্যুৎ আমদানিতে কোনো ধরনের শুল্ককর দেওয়া হচ্ছে না। ২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তিতে অবৈধভাবে শুল্ককর অব্যাহতি দেয় পিডিবি। এতে বড় অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে এনবিআর। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ২০১৪ সালের এক প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করে ২০২২ সালে আদানির বিদ্যুতের ক্ষেত্রে শুল্ককর অব্যাহতি চায় পিডিবি। পরবর্তী সময়ে এনবিআরের অনুমতি চেয়ে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এনবিআরের অনুমতি ছাড়া আদানির সঙ্গে চুক্তিতে কীভাবে শুল্ককর অব্যাহতি দেয়া হলো—তার ব্যাখ্যা চেয়ে একাধিকবার বিদ্যুৎ বিভাগকে চিঠি দিয়েছে এনবিআর। তবে এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও এনবিআরের চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ।

কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর সূত্রমতে, রোববার থেকে কমিটি কাজ শুরু করবে। কমিটি কার্যপরিধির বিবরণ অনুযায়ী, আদানির বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের নির্ধারিত মূল্য এবং তাতে শুল্ককর প্রযোজ্য কী না, সেটি যাচাই করা; এ পর্যন্ত আমদানি করা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শুল্ককরের পরিমাণ কত এবং তা পরিশোধ করা হয়েছে কী না এসব খতিয়ে দেখতে কমিটি। আমদানি করা বিদ্যুতের শুষ্ক-কর মওকুফ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল কি না; থাকলে এ বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন বা আদেশ জারি হয়েছে কি না- এটিও তদন্ত করবে কমিটি।যদি অন্য কোনো বিষয় থাকে, যেটি শুল্ক-করের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত; তাও খতিয়ে দেখার এখতিয়ার দেওয়ার হয়েছে কমিটিকে। এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শেষে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কাজের সুবিধার জন্য প্রয়োজন হলে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কমিটিকে।

এই বিষয়ে এদিপ বিল্লাহ বলেন, আমরা প্রথমেই আদানির সাথে হওয়া চুক্তিটি দেখব, কী ছিল এখানে। এরপর দেখব বিদ্যুৎ আমদানি হত কোন কোন শুল্ক স্টেশন দিয়ে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের ডিক্লারেশন (ঘোষণা) কী ছিল। যে এইচএস কোডের মাধ্যমে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে, সেটি কাস্টমস আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, সেটিও দেখা হবে বলে তথ্য দিয়েছেন কমিটির এই আহ্বায়ক। এদিপ বিল্লাহ বলেন, চুক্তি দিয়ে শুরু করব। কারণ এ ক্ষেত্রে কাস্টমস আইন পরিপালন সঠিকভাবে হয়েছে কি না, দেখার আছে। রোববার থেকে কমিটির কাজ শুরু হবে। কোন কাস্টমস হাউস বা স্টেশন দিয়ে এবং কী প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে এবং আলোচ্য পণ্যের শুল্কায়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে কোনো দপ্তরকে দায়িত্ব দেওয়া আছে কি না; এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে বলে জানাচ্ছেন এদিপ বিল্লাহ।

অপরদিকে, পিডিবির কাছে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতির বিষয়টি জানিয়ে ২০২২ সালের ৮ জুন প্রথম চিঠি দেয় আদানি। এতে পিডিবি ও পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে শুল্ক-কর অব্যাহতি চাওয়া হয়। পাশাপাশি আয়কর অব্যাহতি দেয়ার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে অনুরোধ করে আদানি।

আদানির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৩১ জুলাই বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে চিঠি দেয় পিডিবি। এতে বলা হয়, বিল্ট ওন অপারেট (বিওও) ভিত্তিতে ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় আদানি পাওয়ার (ঝাড়খণ্ড) লিমিটেড (এপিজেএল) কর্তৃক নির্মাণাধীন ২x৮০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বাংলাদেশ ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি ও পিডিবির মধ্যে সম্পাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) এবং আদানি, বাংলাদেশ সরকার ও পিজিসিবির মধ্যে সম্পাদিত বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) স্বাক্ষরিত হয়। আইএ চুক্তির ১২.১ ধারায় আদানির বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে সব ধরনের শুল্ক-কর অব্যাহতির কথা বলা হয়েছে। এ অব্যাহতি দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বা আদেশ প্রদানের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকার পালন করবে।

চিঠিতে পিডিবি আরও জানায়, এর আগে ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেড (এনভিভিএন) থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) মওকুফ করে এনবিআর। এনবিআরের উক্ত অব্যাহতির ভিত্তিতে ভারতের পিটিসি ইন্ডিয়া লিমিটেড, সেম্পকর্প ইন্ডিয়া ও এনভিভিএনের সঙ্গে পৃথক পিপিএর আওতায় আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতির মাধ্যমে আরও ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।

আদানি পাওয়ারের উক্ত কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত আইএ অনুযায়ী আমদানি পর্যায়ে যাবতীয় শুল্ক-কর থেকে অব্যাহতি পাবে কোম্পানিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ আমদানি পর্যায়ের যাবতীয় শুল্ক মওকুফের বিষয়টি বিবেচনা না করলে চুক্তি অনুযায়ী আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট পিডিবি তথা বাংলাদেশ সরকারের ওপর বর্তাবে। তাই আলোচ্য বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্বার্থে বিদ্যুৎ আমদানির ক্ষেত্রে এনভিভিএনকে প্রদানকৃত অব্যাহতির অনুরূপ আদানি পাওয়ারের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ আমদানিতে যাবতীয় শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট অব্যাহতি প্রদানে এনবিআরকে অনুরোধ করতে বলা হয়।

পিডিবির চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট এনবিআরকে চিঠি দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে আদানির সঙ্গে স্বাক্ষরিত আইএ’র ১২.১ অনুযায়ী আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ আমদানি পর্যায়ে যাবতীয় শুল্ক-কর (শুল্ক, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট) অব্যাহতি প্রদানে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের চিঠির উত্তরে ২০২৩ সালের ২ মার্চ পাল্টা চিঠি দেয় এনবিআর। এতে বলা হয়, ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মাণাধীন ১৪৯৬ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমদানিতব্য বিদ্যুতের ওপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-করাদি মওকুফের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তবে চুক্তিতে উল্লিখিত অব্যাহতি প্রদানের বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আগে এনবিআরের কোনোরূপ মতামত গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা, তা দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। এনবিআরের মতামত গ্রহণ করা হলে তার একটি প্রতিলিপিও পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। যদিও এ চিঠির কোনো জবাব দেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। পরে একই বছর ২২ মার্চ ও ১৩ এপ্রিল পুনরায় বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব বরাবর একই চিঠি দেয় এনবিআর। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তার কোনো উত্তর দেয়নি।

অপরদিকে, আদানিকে শুল্ক-কর ছাড় দেয়ার জন্য পিডিবি ২০১৪ সালের এনবিআরের যে নির্দেশনার কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছে, সে সংশ্লিষ্ট এসআরওটি অনুসন্ধান করে বের করা হয়েছে। এনবিআরের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক প্রকল্প অব্যাহতি) নভেরা মোয়াজ্জেম চৌধুরীর সই করা অব্যাহতির চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১০ সালের ১১ জানুয়ারি চুক্তি সই হয়। সে অনুযায়ী পিডিবি ভারতীয় এনটিপিসি বিদ্যুৎ নিগাম লিমিটেডের কাছ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করবে। আমদানি করা এ বিদ্যুতের ওপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর ও ৪ শতাংশ অগ্রিম ট্রেড ভ্যাটসহ মোট ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ শুল্ককর তিনটি শর্ত সাপেক্ষে মওকুফ করা হলো।

অন্যদিকে, আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভারতের ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে আয় হয়েছে সাত হাজার ৩৭০ কোটি রুপি বা প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আদানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে এক হাজার ৪৬৮ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও চতুর্থ প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ওপর ৩১ দশমিক ০৭ শতাংশ হারে শুল্ক-কর প্রদান করলে এক বছরে এনবিআরের প্রায় তিন হাজার ২৩ কোটি টাকা শুল্ক-কর আদায় হতো। তবে অবৈধভাবে অব্যাহতির ফলে এনবিআর এ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গত বছরের ৯ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৩৮ মিনিটে ঝাড়খণ্ডের গড্ডা থেকে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডে সঞ্চালন শুরু হয়।

** ভারত থেকে শুল্ককর ছাড়াই আসছে আদানির বিদ্যুৎ!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!