চরম আর্থিক দুরবস্থায় থাকা ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে না পারা, অতিমাত্রায় খেলাপি ঋণ এবং বিপুল মূলধন ঘাটতির ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একীভূত করে এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি অথবা দুটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে এদের গড় খেলাপি ঋণের হার ৮৩.১৬ শতাংশ। ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকায়, আর মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৯ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকটিকে নোটিশ দিয়েছে—তাদের লাইসেন্স বাতিল না করার যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করতে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে গঠিত একটি কমিটি সম্প্রতি ২০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে শনাক্ত করে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে কমিটি কাজ শুরু করে। তাদেরকে এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য আইনগত ও কারিগরি প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করতে বলা হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উৎস খুঁজে বের করার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সূচক, ঋণের প্রকৃত অবস্থা, তারল্য পরিস্থিতি এবং সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ বিবেচনায় একীভূতকরণ করলে ব্যক্তি আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনের চাহিদা মেটাতে প্রাথমিকভাবে ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা প্রয়োজন হবে।
সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে যেসব ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সেগুলো হলো: এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফার্স্ট ফিন্যান্স, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ফিনিক্স ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, আভিভা ফিন্যান্স, উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স, ন্যাশনাল ফিন্যান্স, হজ ফিন্যান্স, জিএসপি ফিন্যান্স, মেরিডিয়ান ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং সিভিসি ফিন্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, একীভূতকরণের আগে আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না—তা জানতে চেয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৫ দিনের মধ্যে এ নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক আর্থিক বিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পদ দিয়ে আমানতকারীদের দায় পরিশোধ সম্ভব নয়, খেলাপি ঋণের হার অত্যন্ত বেশি এবং ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
মতামত জানতে চাইলে ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আলী জারিয়াব বলেন, একীভূতকরণের উদ্যোগ নিশ্চয়ই ইতিবাচক হবে। তবে এ বিষয়ে তিনি আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ছাড়া সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
ফিন্যান্স কোম্পানি আইন-২০২৩-এর ৭(১) ধারার তিনটি উপধারা লঙ্ঘন হয়েছে কি না—সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ৭(২) ধারার ভিত্তিতে লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না—তা জানাতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, সম্প্রতি জারি করা ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ শুরু করেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যালোচনা চলছে। তিনি জানান, শিগগিরই এসব কার্যক্রমের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে।
একীভূতকরণের জন্য প্রযোজ্য আইন
বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩-এর ৭(১) ধারায় মোট নয়টি কারণ দেখিয়ে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব বিষয় চিঠিতে উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে রয়েছে—‘ঘ’ উপধারা অনুযায়ী আমানতকারীর স্বার্থের পরিপন্থীভাবে ব্যবসা পরিচালনা, ‘ঙ’ উপধারায় সম্পদের অপর্যাপ্ততার কারণে আমানতকারীদের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা এবং ‘চ’ উপধারায় ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে অক্ষমতা। এসব পরিস্থিতিতে লাইসেন্স বাতিলের সুযোগ রয়েছে। তবে আইনের ৭(২) ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্স বাতিলের আগে ১৫ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিতে হবে। সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোটিশ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাদের কার্যক্রম প্রায় নেই বললেই চলে। বছরের পর বছর লোকসানে চলা এসব প্রতিষ্ঠান কেবল টিকে আছে কাগজে-কলমে। এগুলো ব্যাংক খাতে ক্যান্সারের মতো প্রভাব ফেলছে, যার ফলে সুস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোও আমানত সংগ্রহে চাপে পড়ছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে, ভালো সম্পদসমূহ একত্রিত করে একটি বা দুটি শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কিছু ব্যতীত অধিকাংশ আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে দেউলিয়া অবস্থায় আছে এবং তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে সক্ষম নয়। তাই যেকোনো অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক, তবে এটি সুষ্ঠুভাবে এবং ভালো পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।