২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষ দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে পুরো বছরের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। বিপুল রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পড়েছে এক বিব্রতকর বাস্তবতার মুখে, যা নতুন অর্থবছরের শুরুতেই গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিদায়ী বছরে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা—সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বড় ফাঁক। আর মূল লক্ষ্যমাত্রা বিবেচনায় এই ঘাটতি প্রায় ১ লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি কেবল সংখ্যাগত ব্যর্থতা নয়; বরং এটি রাজস্ব ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক অকার্যকরতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার অসামঞ্জস্যের স্পষ্ট প্রতিফলন। রাজস্ব আদায়ের ইতিহাসে এটি এক বড় সতর্কবার্তা, যার প্রভাব নতুন অর্থবছরের শুরুতেই প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজস্ব ঘাটতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগে স্থবিরতা, মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তার ব্যয় সংকোচন, আমদানি কমে যাওয়া এবং রাজস্ব প্রশাসনের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংস্কারে জটিলতা। এসব কারণে রাজস্ব আদায়ের গতি থেমে গেছে, আর কাঠামোগত দুর্বলতার ছায়াও আরও ঘনীভূত হয়েছে। ফলে এটি শুধু সাময়িক ঘাটতির বিষয় নয়, বরং রাজস্ব ব্যবস্থার সক্ষমতা নিয়ে এক গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ১০টা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। অথচ সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি এবং মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ফলে লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে আদায়ের ফারাক রয়ে গেছে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা—যা একটি বড় ঘাটতির চিত্রই তুলে ধরে।
রাজস্ব ঘাটতি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হবে, তবে প্রত্যাশিত হারে হয়নি। আন্দোলনসহ নানা কারণে রাজস্ব আদায়ে বাধা এসেছে।’ তিনি আশা প্রকাশ করেন, ব্যাংক ও দপ্তর খোলা থাকায় শেষ দিনে আদায় কিছুটা বাড়বে এবং জুলাই থেকে আরও জোরালোভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এ ঘাটতি শুধু সময়িক ব্যর্থতা নয়; বরং বহুদিনের গড়িমসি ও কাঠামোগত দুর্বলতার ফল। রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত হারে না বাড়ায় সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনায় বড় চাপ তৈরি হবে। এতে ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর বাড়তি নির্ভরতা তৈরি হতে পারে, যা ভবিষ্যতে দেশকে ঋণের ফাঁদের ঝুঁকিতে ফেলবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজস্ব ঘাটতির এ চিত্র হতাশাজনক। প্রবৃদ্ধির আভাস থাকলেও কর-জিডিপির অনুপাত কমছে, যা বড় উদ্বেগের বিষয়। তাঁর মতে, আয় না বাড়লে নাগরিক চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। তিনি হুঁশিয়ার করে বলেন, সরকারের এই প্রবণতা চলতে থাকলে দেশ বাধ্য হয়ে আরও ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হবে। তাই দেশের বাড়তে থাকা চাহিদা মোকাবিলায় কর ব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কার এখন জরুরি, নইলে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে গিয়েই চাপের মুখে পড়বে অর্থনীতি।
সিপিডির এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। মূল্যস্ফীতি ও আমদানি হ্রাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। করছাড়, সংস্কারে বিলম্ব এবং কর ফাঁকি ঠেকাতে দুর্বলতার ফলে ঘাটতি আরও বেড়েছে। এছাড়া পরামর্শক কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করায় সংস্কারপ্রক্রিয়ায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। করনীতি ও প্রশাসনের অস্থিরতাও পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।