৬ লাখ বিদেশির ১৮ হাজার কোটি টাকা করফাঁকি

নিবন্ধনের বাইরে থাকা প্রায় ছয় লাখ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করছেন, যাদের আইনি কাঠামোর আওতায় আনা গেলে বছরে অন্তত ১৮ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব। তবে কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এমন প্রেক্ষাপটে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে বিদেশি কর্মীদের নিবন্ধন নিশ্চিত করা এবং অর্থ পাচার রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সরকারের কাছে একগুচ্ছ প্রস্তাব পেশ করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানিয়েছে, বর্তমান স্বর্ণ নীতিমালার ফাঁকফোকরকে ব্যবহার করে বিদেশ থেকে সোনার বার ও অলংকার এনে বিপুল অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এজন্য নীতিমালা সংশোধনের পাশাপাশি ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার রোধ, করমুক্ত স্বর্ণ ও অলংকারের পরিমাণ কমিয়ে ৭৫ গ্রাম নির্ধারণ এবং বছরে ৫০ লাখ টাকার বেশি নগদ উত্তোলনে উৎসে কর আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি।

জুনের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। সম্ভাব্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেটকে সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে অর্থ বিভাগ। সংকটময় অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, এবারের বাজেট হবে বাস্তবভিত্তিক, কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষার জায়গা থাকবে না।

সূত্র জানায়, আসন্ন বাজেট কেমন হওয়া উচিত এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ প্রয়োজন—সে বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী সুপারিশ দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিবেদনে অগ্রাধিকার পাওয়া খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, কর ও ভ্যাট নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন, উৎপাদনশীল খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি, দক্ষ জনশক্তি গঠন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার।

অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠানো গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ব্যাংক খাতের অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারি, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের মতো সংকটের মধ্য দিয়ে গত কয়েকটি অর্থবছর অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি ঘাটতির কারণে শিল্প উৎপাদন ও নতুন বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ‘জুলাই বিপ্লব’-এর পর অর্থনীতির গতি অনেকটা শ্লথ হয়ে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক বিক্ষোভের ফলে পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়ছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাল্টাপাল্টি শুল্কারোপকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য যুদ্ধের পাশাপাশি বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামীতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যকরী বাজেট প্রণয়ন করা আবশ্যক।

ঋণখেলাপি

ঋণখেলাপি ইস্যুতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনবিআরে জমা দেওয়া আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার সময় জমা দেওয়া সম্পদ বিবরণীর মধ্যে বড় ধরনের অসঙ্গতি থাকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা ড্রাইভার, দারোয়ান বা অফিস সহায়কদের নামে ভুয়া ব্যবসা দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়, যা পরে আদায় করা সম্ভব হয় না। প্রতিবেদনে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, বড় অঙ্কের ঋণ অনুমোদনের আগে ব্যাংকগুলো যেন এনবিআরের নির্দিষ্ট ডাটাবেস থেকে গ্রাহকের ব্যবসায়িক তথ্য যাচাই করে। এতে একদিকে যেমন ঋণ জালিয়াতি কমবে, তেমনি রাজস্ব আদায় বাড়বে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ

গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে শুধু বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেখা যাচ্ছে—যেমন সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে জনঅসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশের ভেতরেও লাগাতার মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার ফলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও জনমনে অসন্তোষ বাড়ছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে শুল্কারোপ আরও বাড়লে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হবে, যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও তীব্র হতে পারে। এই বাস্তবতায় দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও এটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান হুমকি হিসেবে দেখছে। এ প্রেক্ষাপটে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বিস্তারে খাতভিত্তিক অতিরিক্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করার পাশাপাশি, মুদ্রানীতিতেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নিতে হবে।

অনিবন্ধিত কুরিয়ার সার্ভিস

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ই-কমার্স ও ফেসবুকভিত্তিক অনেক প্রতিষ্ঠান অনিবন্ধিত কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ করে, যার ফলে অবৈধ পণ্যের লেনদেনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনিবন্ধিত কুরিয়ার সার্ভিসগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধনের আওতায় এনে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভ্যাট ও কর আদায়ের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট ফাঁকি রোধ এবং ভ্যাট আদায়ে স্বচ্ছতা আনতে ইএফডি স্থাপন কার্যক্রম দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে ইএফডি না বসিয়ে, সমজাতীয় দোকান ও প্রতিষ্ঠানে মেশিন বসিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এছাড়া, রপ্তানিমুখী শিল্পের উপকরণ আমদানিতে গার্মেন্টস শিল্পের মতো অন্যান্য খাতেও বন্ড সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। পুঁজিবাজারকে চাঙা করতে এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে লভ্যাংশে ব্যক্তি পর্যায়ে করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করার পাশাপাশি পুঁজিবাজার বান্ধব করনীতি গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!