গত ১৬ বছরে দেশের শেয়ারবাজার প্রায় ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে দেখলে, এ সময়ে বিনিয়োগকারীরা মুনাফা তো পাননি, বরং প্রতিবছর গড়ে ৩ শতাংশ হারে মূলধন হারিয়েছেন। অন্যদিকে, একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বাজারকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে।
গত ১৬ বছরে শেয়ারবাজারে ১৩৪টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, যা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজার থেকে ৯ হাজার কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহ করেছে। তবে এসব কোম্পানির মধ্যে ৪২টি এখন দুর্বল হয়ে ‘জেড’ শ্রেণিতে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা এসব কোম্পানি থেকে মুনাফা তো পাননি, বরং শেয়ার কিনে মূলধন হারিয়েছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিবিএ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় শেয়ারবাজারের বর্তমান চিত্র তুলে ধরা হয়। সভার শুরুতে ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. সাইফউদ্দিন গত ১৬ বছরের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে একটি পাওয়ার প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। বাজার ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৬ বছর আগে কেউ যদি ১০০ টাকা বিনিয়োগ করতেন, মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে এখন তার লোকসান দাঁড়ায় ৩৮ টাকা। অর্থাৎ, অর্থনীতি বড় হলেও প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বড় পুঁজি হারিয়েছেন, যার ফলে বাজার প্রসারিত হওয়ার বদলে সংকুচিত হয়েছে।
উপস্থাপনায় আরও বলা হয়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬০টি কোম্পানির মধ্যে বর্তমানে ১০৩টি দুর্বল মানের ‘জেড’ শ্রেণিতে রয়েছে। শুধু নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোই খারাপ অবস্থায় নেই, মিউচুয়াল ফান্ড ও শেয়ারের বিপরীতে নেওয়া ঋণও বাজারে বড় সংকট তৈরি করেছে। বর্তমানে শেয়ারের বিপরীতে নেওয়া মার্জিন ঋণের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণাত্মক বা নেগেটিভ ইক্যুইটিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, এই ঋণের প্রায় অর্ধেক আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না, যার ফলে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়েছে।
সাইফউদ্দিন তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে ৪৫০টি ব্রোকারেজ হাউস, ৬৭টি মার্চেন্ট ব্যাংক, ৩৯টি সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা রয়েছে। বাজারের আকার বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের এই সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ার মিলনায়তনে বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনা ও সভাপতিত্বে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক ব্যাংক সুপারভাইজার সাবিদ সিদ্দিকী, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ, ইআরএফ সভাপতি দৌলত আকতার এবং সিএমজেএফ সভাপতি গোলাম সামদানী।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো সরকারই শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে গ্রহণ করেনি। তবে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিকভাবে শেয়ারবাজারকে শোষণ করেছে। ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে আমরা শেয়ারবাজারকে স্বীকৃতি দেব এবং একে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত করব।’ পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজার লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিও জানান বিএনপির এই নেতা।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গত দুই কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়, যা দুঃখজনক। প্রশ্নবিদ্ধ নানা কোম্পানিকে তারা বাজারে এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাবিদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে হলে কোম্পানির নিরীক্ষকদের আরও বেশি তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের মতো ছোট বাজারে এত বেশি তদন্ত ও তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, যা বিশ্বের অন্য কোথাও দেখা যায় না। গত সরকারের রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ফলে যে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণি তৈরি হয়েছে, শেয়ারবাজার তারই একটি উদাহরণ। এখানে বিনিয়োগের গল্প তৈরি করে শেয়ারের দাম কৃত্রিমভাবে বাড়ানো ও কমানোর ঘটনা ঘটেছে।