বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এ বিষয়ে তদন্তের অংশ হিসেবে ৭২টি বিমা কোম্পানির নিরীক্ষা শুরু হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৫টি কোম্পানির প্রায় ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ফাঁকি ধরা পড়েছে সাধারণ বিমা করপোরেশনের, যার পরিমাণ প্রায় ৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফাঁকির তালিকায় রয়েছে গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স, রূপালী ইন্স্যুরেন্স, মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স, আলফাহ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি।
ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হওয়ার পর ১৫টি কোম্পানির মধ্যে তিনটি কোম্পানি প্রায় এক কোটি ৬৬ লাখ টাকার ভ্যাট পরিশোধ করেছে। বাকি ১২টি কোম্পানির ভ্যাট আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান। এ ছাড়া ৫৭টি বিমা কোম্পানির নিরীক্ষা এখনো চলছে। এনবিআর জানিয়েছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে সব কোম্পানির নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও নিরীক্ষা কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তারা আশা করছেন, নিরীক্ষার মাধ্যমে এসব কোম্পানি ভ্যাট কমপ্লায়েন্সে আসবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিমা কোম্পানির প্রদত্ত সেবা বা গ্রহণকৃত ফি ও চার্জের বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। পাশাপাশি, তারা যে পণ্য বা সেবা গ্রহণ করে, তার ওপরও উৎসে মূসক আরোপিত হয়। ভ্যাট ফাঁকি চিহ্নিত করতে সম্প্রতি এনবিআর ৭২টি বিমা কোম্পানির তালিকা তৈরি করে।এসব কোম্পানির নিরীক্ষার দায়িত্ব বিভিন্ন সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) আওতায় রয়েছে ছয়টি কোম্পানি, ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের অধীনে ১৬টি, ভ্যাট ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের আওতায় ১৬টি এবং মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা) ৩৪টি বিমা কোম্পানির নিরীক্ষার দায়িত্ব পেয়েছে।
এনবিআরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, নিরীক্ষা চলমান থাকা ৭২ বিমা কোম্পানির মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫টির নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যার মধ্যে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা) নয়টির নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। যাতে ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে ১৬ কোটি ৭৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৬৩ টাকা। এর মধ্যে তিনটি কোম্পানির উদ্ঘাটিত ফাঁকি দেয়া ভ্যাটের ১ কোটি ৬৬ লাখ ৩২ হাজার ৯৭৪ টাকা পরিশোধ করেছে। কোম্পানি তিনটি হলোÑআলফা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড প্রাথমিকভাবে উদ্ঘাটিত ১ কোটি ১২ লাখ ৪ হাজার ৪৭১ টাকার মধ্যে ৮৮ লাখ ২৯ হাজার ৪৩৩ টাকা পরিশোধ করেছে। এছাড়া সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ২৪ লাখ ৩২ হাজার ২৭৭ টাকা ও রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের উদ্ঘাটিত ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ২৬৪ টাকার ফাঁকি দেয়া ভ্যাট পরিশোধ করেছে।
অপরদিকে, ভ্যাট গোয়েন্দা আরও ছয়টি কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে। যার মধ্যে রয়েছে সাউথ এশিয়া ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার ৪০৭ টাকা, ডায়মন্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এক কোটি ২ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫০ টাকা, মার্কেন্টাইল ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ৯ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩৯ টাকা, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ৬ কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ১০১ টাকা, এনআরবি ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড ১ কোটি ৭১ লাখ ৭ হাজার ১৭৬ টাকা, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড এক কোটি ৬০ লাখ ৫২ হাজার ৯২৩ টাকা, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড ৬০ লাখ ২১ হাজার ৫২ টাকা ও হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড দুই কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার ৬০১ টাকা।
হিসাবে আরও দেখা গেছে, নিরীক্ষা সম্পন্ন হওয়া ১৫টি বিমা কোম্পানির মধ্যে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের তিনটি ও বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) তিনটি কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠানের মোট ৫২ লাখ ৭১ হাজার ২২৫ টাকা ভ্যাট ফাঁকি ধরা পড়েছে। এদের মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে, আর একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রক্রিয়া চলমান। এই তিনটি কোম্পানি হলো—মার্কেন্টাইল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (১০ লাখ ৬৫ হাজার ১৫৩ টাকা), এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড (২৯ লাখ ৫ হাজার ৮৭৯ টাকা) ও প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (১৩ লাখ ১৯৩ টাকা)।
অন্যদিকে, এলটিইউয়ের নিরীক্ষায় তিনটি বিমা কোম্পানির মোট প্রায় ৪২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট তিনটি কোম্পানি হলো—রূপালী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (১ কোটি ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯ টাকা), গ্রিন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (৩ কোটি ৭ লাখ ৭০ হাজার ১৪১ টাকা) এবং সাধারণ বিমা করপোরেশন (৩৮ কোটি ৩২ লাখ ৫৬ হাজার ৫২৮ টাকা)।
এই বিষয়ে এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ফাঁকি উদ্ঘাটন নিয়মিত ঘটনা। তবে এসব ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে একদিকে ফাঁকি রোধ, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে কোম্পানিগুলো কমপ্লায়েন্সের আওতায় আসবে। ৭২টি কোম্পানির মধ্যে ইতোমধ্যে ১৫টির নিরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে, যাতে প্রায় ৫৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। প্রায় এক কোটি ৬৬ লাখ টাকা আদায়ও হয়েছে। বাকি কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষা দ্রুত শেষ হবে। এনবিআর থেকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। সবগুলোর নিরীক্ষা শেষ হলে আশা করি ভালো অঙ্কের ফাঁকি উদ্ঘাটিত হবে।