গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ঘটে যাওয়া অনিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভূমিকা এবং ঋণ ছাড়ের নীতির আওতায় সুবিধা পাওয়া ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি থেকে পাঠানো চিঠিতে সাবেক তিন গভর্নর, পাঁচ ডেপুটি গভর্নর এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক সাবেক প্রধানসহ ১০টি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর তথ্য চাওয়া হয়েছে।
গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্বল তদারকি এবং একের পর এক শিথিল নীতিমালার কারণে ঋণ খেলাপির পরিমাণ বেড়েছে। এসব নীতিমালার ফলে খেলাপিরা সহজ শর্তে ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পেয়েছে। চলতি বছরের মে মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো চিঠিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ করে, দায়িত্বে থাকা কিছু ব্যক্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন নীতিমালা তৈরি করেছিলেন, যা প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ঋণ খেলাপিদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
দুদকের পাঠানো চিঠিতে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, ফজলে কবির এবং আব্দুর রউফ তালুকদারের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ঋণনীতির অপব্যবহার, ঋণ কেলেঙ্কারিতে সহায়তা এবং রিজার্ভ চুরি, হলমার্ক জালিয়াতি ও এস আলম গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির মতো বড় দুর্নীতির ঘটনা ঠেকাতে ব্যর্থতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগের অনুসন্ধানে ২০০৯ সালের আগে ও পরে জারি হওয়া ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালার সত্যায়িত কপি, ব্যাংক পরিদর্শন সংক্রান্ত নির্দেশনার অনুলিপিসহ বিভিন্ন নথিপত্র চেয়েছে দুদক।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে চিঠি পাঠিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালার সুবিধা পাওয়া ১০টি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর ঋণসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য চেয়েছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে—বেক্সিমকো, এমআর গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, কেয়া গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, থার্মেক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, বিবিএস গ্রুপ, আবদুল মোনেম গ্রুপ এবং এনেটেক্স গ্রুপ।
ব্যাংকগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে, উল্লিখিত ১০ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নামে ও বেনামে নেওয়া সব ঋণের বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে। ইতোমধ্যে অধিকাংশ ব্যাংকই এ নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত—অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে—যেসব ঋণ খেলাপি হয়েছে, সেসবের তথ্যও চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি এবং রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া সালমান এফ রহমানের চিঠির পর ২০১৫ সালে প্রণীত ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালার অনুলিপি, ইসলামী ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে শেয়ার ক্রয়, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত তথ্য, ৯ শতাংশ সুদের সার্কুলার এবং খেলাপি ঋণ থেকে অব্যাহতির নীতিমালাও চেয়েছে কমিশন।
২০১৩ সালে তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর এস কে সুরেশের সময় অনুমোদন পাওয়া ইউনিয়ন ব্যাংক ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকসহ চতুর্থ প্রজন্মের ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন-সংক্রান্ত নথিপত্র চেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একই সঙ্গে সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসেরের সময় জারি করা ঋণ নীতিমালার নোটও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সাবেক গভর্নরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত আব্দুর রউফ তালুকদারের সময় রিজার্ভ থেকে ব্যবসায়ীদের ডলার সরবরাহ এবং সন্দেহজনক ঋণ বিতরণ সংক্রান্ত তথ্যও চেয়েছে দুদক। এসব বিষয়ে যদি কোনো অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন থেকে থাকে, তার অনুলিপিও জমা দিতে বলা হয়েছে।
সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও বিএফআইইউ প্রধান কাজী সাইদুর রহমানের সময় ডলার বাজারে অস্থিরতা, সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসানের সময়ে অর্থপাচার, এবং এস এম মনিরুজ্জামানের সময় ব্যাংক পরিদর্শনের তথ্যও দুদকের চিঠিতে চাওয়া হয়েছে। এসব তথ্য ২৫ জুন সকাল ১১টার মধ্যে জমা দিতে অনুরোধ করা হয়েছে। তথ্য প্রদান হয়েছে কি না তা জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খানকে একাধিকবার ফোন করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুদকের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে। তবে ঈদুল আজহার কারণে ব্যাংক খাত ১০ দিন বন্ধ থাকায় এবং ১৫ বছরের তথ্য একত্রিত করা জটিল হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সময় নিতে হচ্ছে। চিঠি সম্পর্কে জানতে দুদকের একজন উপপরিচালকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।