মাঠজুড়ে তরমুজের সমারোহ। বরগুনার কৃষক তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর মাঠ থেকে বাজারে পাঠাচ্ছেন তরমুজ। বাম্পার ফলনে লাভের স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবতা ভিন্ন। হাত বদল হলেই তরমুজের দাম লাফিয়ে বাড়ছে। চার হাত ঘুরে ১৫০ টাকার তরমুজ বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়। মৌসুমের প্রথম ফসল বাজারে আসার পরও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, খুচরা বিক্রেতারাই দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন, যা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে।
সরজমিনে কৃষকের ক্ষেত, পাইকার, আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে গিয়ে জানা যায়, কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা ৪ হাত ঘুরে প্রায় চার গুণ বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে তরমুজ। সাধারণত কৃষকদের কাছ থেকে তরমুজ কিনে থাকেন পাইকাররা, কখনো ক্ষেত চুক্তিতে, কখনো পিস হিসেবে। ক্ষেত থেকে পিস হিসেবে কেনা তরমুজ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয় আড়তদারদের কাছে। ক্ষেত থেকে কৃষক প্রতি পিস তরমুজ বিক্রি করছেন ১৫০ টাকায়। পাইকার ও আড়তদারদের হাতে পরে সেটি বিভিন্ন সাইজে ভাগ হয়ে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে ৩০০ টাকায়। খুচরা বিক্রেতা ৩০০ টাকায় কেনা তরমুজই ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এতে খুচরা বিক্রেতারা লাভ করছেন শতকরা ৬০-১৩০ ভাগ।
আড়তদার ও খুচরা বিক্রেতারা দ্বিগুণ লাভ করলেও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক, আর সিন্ডিকেটের কবলে ভোক্তারা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন চড়া দামে। কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী, কৃষক থেকে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ লাভ করা যায়। অথচ বাস্তবে খুচরা বিক্রেতারা ৬০-১৩০ শতাংশ পর্যন্ত লাভ করছেন।
বরগুনা কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর তরমুজের আবাদ বেড়েছে। ১২,৩০০ হেক্টর জমিতে চাষ হওয়া তরমুজের সম্ভাব্য বাজারমূল্য ১,৭০০ কোটি টাকা। বরগুনায় নির্ধারিত ৮,৩০০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে।
এ বছর ফলন ভালো হয়েছে জানিয়ে তরমুজ চাষি আব্দুল মন্নান জানান, তিনি ১০ কানি জমিতে তরমুজ আবাদ করেছেন। প্রতি কানিতে প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ করে ৫০ হাজার টাকা লাভ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে লবণগোলা এলাকার তরমুজ চাষি নয়ন মিয়া করে বলেন, আমরা এখানে তিন থেকে চার মাস কষ্ট করে ফসল ফলাই। এ বছর সার ও কীটনাশকের দাম বাড়তি। এছাড়া লেবার খরচ, খাবার খরচ সবকিছুই বেশি। কিন্তু পাইকাররা আমাদের থেকে মাত্র ৮০-১২০ টাকায় তরমুজ কিনছেন। অথচ আমাদের তরমুজ বাজারে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। আমরা সবসময় লসেই থাকি।
তরমুজ বিক্রির ধাপ নিয়ে পটুয়াখালী থেকে আসা পাইকার আবুল কালাম বলেন, তরমুজ পাকার সময় হলে আমরা কৃষকের জমি কিনি। স্থানীয় কানির হিসেবে ৪-৬ লাখ টাকা দরে এক কানি জমির তরমুজ কিনে থাকি। পরে সংগ্রহ, পরিবহন ও খাজনাসহ একেকটি তরমুজ ২০০ টাকার মতো খরচ পড়ে, যা গড়ে ২২০ টাকায় আড়তদারের কাছে বিক্রি করি। গত বছর প্রথমে তরমুজের দাম বেশি থাকলেও পরে দাম কমে যায়। এ বছর দাম মোটামুটি ভালো আছে।
অপরদিকে বাজারে তরমুজের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেন ক্রেতা আল-আমিন হিরা। তিনি বলেন, এখন তরমুজের ভরা মৌসুম, তাই বাজারেও পর্যাপ্ত তরমুজ আছে। কিন্তু দামের দিক থেকে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। ২০০ টাকার একটি তরমুজ ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি করছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে তরমুজ এখন ভোগ্যপণ্য নয়, বিলাসিতার পণ্য হয়ে গেছে।
বিষয়টি নিয়ে বরগুনার কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. শাহ্জাহান আলী বলেন, কৃষি বিপণন বিধি অনুযায়ী তরমুজের ক্ষেত্রে উৎপাদনের পর থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে ৩০ শতাংশ লাভ করতে পারবে। বাজারে কিছু অসংগতি রয়েছে, যা আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। আমরা বাজারে গেলে দাম ঠিক থাকে, চলে এলেই আবার দাম বেশি রাখার চেষ্টা করে। আর ভোক্তা হিসেবেও আমরা সচেতন না হওয়ার সুযোগটা ব্যবসায়ীরা নিচ্ছে। ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।
খুচরা বিক্রেতাদের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুচন্দ্র মণ্ডল জানান, রমজানের শুরু থেকেই তরমুজের ক্ষেত থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত মনিটরিং করা হচ্ছে। ক্ষেত ও পাইকারি বাজারে তরমুজের দাম যৌক্তিক থাকলেও খুচরা বিক্রেতারা বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছেন। পাইকারি বাজারে ২৭০ টাকায় বিক্রি হওয়া তরমুজ খুচরায় ৫০০-৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।