চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে নজিরবিহীন লুটপাট চালালেও তাদের সহযোগী হিসেবে কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপও ছিল। এর মধ্যে রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ অন্যতম, যারা একইভাবে ব্যাংক লুটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানসহ নানা ছলছাতুরির মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক থেকে গ্রুপটি ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি লুটে নিয়েছে। যদিও এস আলমের মতো নাবিল গ্রুপের এই লুটপাটের খবর কোনো এক অজানা কারণে সংবাদমাধ্যমের পাদপ্রদীপের আলোতে আসেনি।
নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম স্বপনের রাজনৈতিক মঞ্চে উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি লুট করেও রাজনৈতিক দলের আস্কারায় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর রাজশাহী অঞ্চলের কর্মী সম্মেলনে স্বপনের উপস্থিতি এই প্রশ্ন আরও জোরালো করেছে—নাবিল গ্রুপের এই নিরাপত্তার নেপথ্যে কি জামায়াতের আশীর্বাদ?
ব্যাংক লুটে এস আলমের সহযোগী নাবিল গ্রুপ
২০২২ সালের ২৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ‘ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর’ খবরটি দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছিল। ওই সংবাদ প্রকাশের পর চট্টগ্রামের এস আলমের পাশাপাশি রাজশাহীর নাবিল গ্রুপও তখন আলোচনার শীর্ষে।সেই সংবাদে বলা হয়েছিল—নাবিল গ্রেইন ক্রপস লিমিটেড ও মার্টস বিজনেস লিমিটেডের নামে ব্যাংক থেকে যথাক্রমে ১০১১ ও ৯৮১ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ভুয়া ঠিকানা ও নামসর্বস্ব দুই প্রতিষ্ঠান খুলে এভাবে ঋণের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ দুটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছিল ইসলামী ব্যাংকের গুলশান সার্কেল-২ ও ফার্মগেট শাখা।
এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে যে অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা লুটপাট করেছে, সেটা বিশ্বের ব্যাংকিং ইতিহাসে বিরল। তবে নাবিল গ্রুপের লুটপাটের পরিমাণও বিপুল অংকের। কিন্তু এস আলমকে নিয়ে যে পরিমাণ মিডিয়া কাভারেজ বা আলোচনা আছে, খুব বিস্ময়করভাবে নাবিল গ্রুপ নিয়ে তেমন আলোচনা নেই!অভিযোগ রয়েছে, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এ্যানন টেক্স, ক্রিসেন্ট গ্রুপের নামে পত্রিকায় ঋণ কেলেঙ্কারির এত এত সংবাদ থাকলেও, নাবিল গ্রুপের কেলেঙ্কারির খবর খুব কমই পত্রিকায় এসেছে। যদিও নাবিল গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির পরিমাণ উপরের বিতর্কিত গ্রুপগুলোর সম্মিলিত ঋণের পরিমাণের চেয়েও বেশি।
নাবিল গ্রুপের লুটপাটের আংশিক চিত্র
শুধু ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকেই নাবিল গ্রুপ ভুয়া ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বেশি। ঋণ পেতে নাবিলের ব্যবহার করা ওই ভুয়া ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে—আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল প্রোডাক্ট প্যালেস, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও আনোয়ারা ফিড মিলস লিমিটেড। এর পাশাপাশি রাজশাহীস্থ ব্যাংকের একই শাখায় নাবিলের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে ফান্ডেড ও নন ফান্ডেড মিলিয়ে মোট ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৯০০ কোটি টাকা। এই ঋণগুলো নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম স্বপনের নামে।
ভুয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ভিন্ন, সুবিধাভোগী নাবিল
এদিকে, ভুয়া ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক হিসেবে দেখানো হয়েছে নাবিল গ্রুপের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে। কোনটার মালিক আবার আমিনুল ইসলাম স্বপনের বাবা। অর্থাৎ কাগজে-কলমে এই প্রতিষ্ঠানগুলো স্বপন তার নিজের নামে রাখেননি। অভিযোগ রয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরির উদ্দেশ্যই ছিল অসৎ। ভিন্ন ব্যক্তির নামে মালিকানা থাকলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে নেওয়া ঋণগুলোর পুরো সুবিধাভোগী (বেনেফিশিয়ারি) স্বপন। প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই নামসর্বস্ব এবং বাস্তবে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র ব্যাংকের টাকা লুটপাটের জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
আরও অভিযোগ রয়েছে, খুবই অস্বাভাবিক এবং ব্যাংকিং নিয়মাচার লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই বিনিয়োগগুলো বিতরণ করা হয়েছে। এই ঋণগুলোর বিপরীতে বর্তমানে খুব নূন্যতম জামানত আছে। সবচেয়ে গুরুতর ব্যাপার হচ্ছে, এই ঋণগুলো দেওয়ার পর সেই ঋণের টাকা থেকেই অল্পকিছু পরিমাণ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে সেটাই জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিছু কিছু ঋণের মেয়াদ পূর্তি হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এক টাকাও আদায় হয়নি। তাই সেগুলো পুনঃতফশিল (রি-সিডিউল) করা হয়েছে। আবার সেই রি-সিডিউলের ডাউন পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে জামানত হিসেবে রাখা সেই ফিক্সড ডিপোজিট থেকেই।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে নাবিল গ্রুপকে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন। কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ঋণ অনুমোদিত হয়েছে। এটি এস আলম গ্রুপের ব্যাংক লুটপাটের মতো আরেকটি বড় অনিয়ম হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নিজের নামে নেওয়া ঋণেও নাবিলের চেয়ারম্যানের অনিয়ম
নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম স্বপন ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া ঋণে বড় ধরনের অনিয়ম করেছেন। জামানত হিসেবে দেখানো জমির মূল্য বাজার মূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। তার নামে থাকা ২৯০০ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী জামানতের প্রকৃত মূল্য (FSV) মাত্র ৫২৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়াও, ব্যাংক নিয়মবহির্ভূতভাবে নানাভাবে সহায়তা করেছে নাবিল গ্রুপকে। প্রয়োজনীয় এলসি মার্জিন না রাখা, এলসি কমিশন কম করে রাখা এবং কোভিডকালীন সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজের টাকার অপব্যবহার। আর এভাবে নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা। মূলত এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই এই হাজার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতি সম্ভব হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
নাবিল গ্রুপের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা
এদিকে, নাবিল গ্রুপের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের সুসম্পর্কের রহস্যের নেপথ্য কিছুটা আন্দাজ করা যায় চলতি বছরের গত ১৮ জানুয়ারি। ওইদিন রাজশাহীতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই কর্মী সম্মেলনের মঞ্চের পেছন দিকে নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান স্বপনকে দেখা যায়।
নাবিল গ্রুপের মতো ব্যাংক লুটপাটকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অপেক্ষায় রয়েছে—এমন প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দীনের দেশে ফিরে এস আলমের গাড়িবহরে ওঠা, জামায়াতের আমিরের রাজশাহী সফরে নাবিল গ্রুপের মার্সিডিজ ব্যবহার এবং গ্রুপ চেয়ারম্যানের বাসায় আপ্যায়িত হওয়া এসব ঘটনার মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ইঙ্গিত মিলছে। এছাড়া, জামায়াতের রাজশাহী অঞ্চলের কর্মী সম্মেলনে নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যানের উপস্থিতিও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান স্বপনের মতো প্রমাণিত ব্যাংক লুটেরাকে মঞ্চে স্থান দেওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। দলটির সাধারণ কর্মী-সমর্থক ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে জামায়াতকে স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিতে হবে।
সূত্র-বাংলা আউটলুক