জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যখন মানুষ জীবনবিমা করেন, তখন তারা আশা করেন দুঃসময়ে একটি নির্ভরযোগ্য সহায়তা পাবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সেই আশ্রয়ের ছাদটাই ভেঙে পড়ছে। প্রতিবছর লাখ লাখ জীবনবিমা পলিসি বাতিল বা তামাদি হয়ে যাচ্ছে শুধু প্রিমিয়াম সময়মতো না দেওয়ার কারণে। ফলে বিমাকারীর মৃত্যুর পর অনেক পরিবারই এই বিমা থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে না, যদিও তারা আগে নিয়মিত গ্রাহক ছিল।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ পর্যন্ত দেশের ৩৫টি জীবনবীমা কোম্পানির মোট ৭০ লাখ ৮৬ হাজার পলিসির মধ্যে অন্তত ১২ লাখ ৫০ হাজার পলিসি কার্যকারিতা হারিয়েছে, যা মোট পলিসির ১৭.৬৪ শতাংশ।
তালিকার শীর্ষে রয়েছে নতুন প্রজন্মের কোম্পানি সোনালী লাইফ ইনস্যুরেন্স। এই প্রতিষ্ঠানের মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৩১১টি পলিসির মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৬৬৮টি পলিসি তামাদি, যা প্রায় ৮৩.৩৪ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ডেল্টা লাইফ, যেখানে ১০ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯৭টি পলিসির মধ্যে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬৮টি তামাদি। তৃতীয় স্থানে থাকা পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ৭ লাখ ২৫ হাজার ৭৬৬টি পলিসির মধ্যে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৯টি পলিসি তামাদি হয়েছে। ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্সের মোট ১৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭৯৫টি পলিসির মধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৪৫টি পলিসি তামাদি হয়েছে। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এই হার উদ্বেগজনক, যা বিমা খাতে আস্থার সংকট এবং কাঠামোগত দুর্বলতার গভীরতা প্রমাণ করে।
অন্যদিকে, এই তামাদি পলিসির বিপরীতে গ্রাহকদের দাবি ছিল ১২ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা, তবে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, বিমা কোম্পানির কাছে ৪ হাজার ৩৫ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এই টাকা পেতে ভুক্তভোগীরা বছরের পর বছর ধরে কোম্পানির অফিস, আইডিআরএ এবং সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক মো. মাইন উদ্দিন সরাসরি দায় দিয়েছেন কমিশনভিত্তিক বিক্রয় ব্যবস্থার ওপর। তাঁর ভাষ্য, ‘এজেন্টদের দু-তিন বছরের জন্য অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া হয়, যার ফলে তারা আত্মীয়-পরিজনদের জোরপূর্বক বিমায় অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীতে খোঁজ না রাখায় গ্রাহকরাও বিমা চালু রাখেন না।’ এজেন্টের হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, পলিসির শর্তাবলি সঠিকভাবে না বোঝানো এবং অনলাইন প্রিমিয়াম পেমেন্টের জটিলতা—এসব কারণে গ্রাহক ধীরে ধীরে বিমা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। অনেকেই বলেন, ‘যা দিয়েছি তা গেল, আর দেব না।’
আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম স্বীকার করেছেন যে, তামাদি বিমা নিয়েই তারা বর্তমানে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তাঁর ভাষায়, বিমা কার্যক্রম শুধু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্টদের মাধ্যমে করাতে হবে। অন্যথায়, কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, পলিসির সংখ্যা যতই বাড়ুক না কেন, যদি তা কার্যকর না হয়, তবে সেটি কেবল মাত্র সংখ্যা হয়ে থাকে। আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এখনই প্রয়োজন কঠোর নিয়ন্ত্রক ভূমিকা, কমিশন কাঠামোয় সংস্কার, সহজ ও স্বচ্ছ প্রিমিয়াম পেমেন্ট ব্যবস্থা এবং এজেন্টদের ওপর জবাবদিহিমূলক নজরদারি। না হলে দেশের লাখো মানুষ ভবিষ্যৎ সুরক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এবং দেশের বিমা খাত বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে কখনোই স্থির হতে পারবে না।