গণঅভ্যুত্থানের পর গত ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোট ৩৯৯টি মামলা করেছে, অর্থাৎ গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৩৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট এক হাজার ২৬৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা। অভিযুক্তদের মধ্যে সরকারি কর্মচারীর হার প্রায় ২৭ শতাংশ। সম্প্রতি দুদক প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কার্যক্রমে দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর প্রথম তিন মাস দুদকের নেতৃত্বে ছিলেন মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, যিনি আগের সরকার আমলে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরে ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর তিনি এবং কমিশনের অন্য সদস্যরা পদত্যাগ করেন। প্রায় দেড় মাস পর ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে একটি নতুন কমিশন দুদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের অপরাধকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি, কারণ অধিকাংশ দুর্নীতির মামলার সঙ্গে তারা জড়িত।’ তিনি জানান, গত ৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত দুটি কমিশনের কার্যকালে মোট ৭৬৮টি অভিযোগ প্রাথমিক তদন্তের জন্য গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯৯টি মামলার পাশাপাশি ২৩১টি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে এবং নয়টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুদক থেকে ২২৩টি সম্পদ বিবরণী জমার নোটিশও পাঠানো হয়েছে। ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের নেতৃত্বে বর্তমান কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে এক মাসেই সর্বোচ্চ ৭০টি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলাগুলোর এক হাজার ২৬৪ জন অভিযুক্তের মধ্যে ২৪৩ জন সরকারি কর্মকর্তা, ১১৪ জন ব্যবসায়ী, ৯২ জন রাজনীতিবিদ, ৪৪৭ জন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী এবং ৩১ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত ও পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ, বোন শেখ রেহানা, রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি, মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তি এবং টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিকের নাম। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ–ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীও।
দুদক সূত্র জানায়, মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার, বড় বড় সরকারি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি, অবৈধ প্লট বরাদ্দ এবং বৈধ আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারে কারচুপি ও অবৈধ জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুইজারল্যান্ড ও কানাডায় বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করার অভিযোগও আনা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারসাজি, বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাজার কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে ভুয়া ঋণের মাধ্যমে বিপুল অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে, কিছু মামলায় তাড়াহুড়ো করে তদন্ত করা হয়েছে এবং যথাযথ অনুসন্ধান ছাড়া মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা সতর্ক করেছেন, এ ধরনের ত্রুটির কারণে আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে। গত ১১ মাসে দুদকে মোট ১২ হাজার ৮২৭টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যার মধ্যে মাত্র গত বছরের নভেম্বরে ৩ হাজার ৪০৬টি অভিযোগ এসেছে। এছাড়া দুদক চেয়ারম্যানের দপ্তর ও অন্যান্য বিভাগ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩ হাজার ৫০০টি অভিযোগের ওপরও কাজ চলছে।