রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয় ১৬ গ্রাহক। এসব ঋণের বিপরীতে যে জামানত রাখা হয়েছে, তার বাজারমূল্য মাত্র ১১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এই ১৬ গ্রাহকই বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যা সালমান এফ রহমানের অধীনে। শুধু জনতা ব্যাংক নয়, বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দিয়ে একইভাবে বিপদে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি ডজনখানেক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বেক্সিমকো গ্রুপের ৩১টি প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা, সোনালী, রূপালী, এবিসহ বিভিন্ন ব্যাংকের অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ২৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকেরই রয়েছে প্রায় ২২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে ব্যাংক খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। নিজের স্বার্থে তিনি ব্যাংকগুলোর ঋণ নীতিমালা পরিবর্তন করাতেন এবং কোনো ব্যাংকই সালমানের চাহিদার বিরুদ্ধে ঋণ প্রদান করতে সাহস পেত না। ঋণ ছাড় দেওয়ার বিষয়টি তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করত, এবং ঋণের বিপরীতে জামানত রাখার বিষয়টি ছিল গ্রাহকের ইচ্ছা। সালমানের প্রভাবের কারণে কোনো ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেও সাহস পেত না।
বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট ঋণের স্থিতি ৯১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা, এর মধ্যে ৬০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা খেলাপি। জনতা ব্যাংকের প্রায় ২২ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা ঋণ গেছে বেক্সিমকো গ্রুপে, যার বিপরীতে কোনো জামানত রাখা হয়নি। জামানত ছাড়া ঋণ দেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে অ্যাডভেঞ্চার গার্মেন্টস (৫৬৬ কোটি), অ্যাপোলো অ্যাপারেলস (৮০১ কোটি), অটোমলুপ অ্যাপারেলস (৭৭২ কোটি), কসমোপলিটন অ্যাপারেলস (৮৫৬ কোটি), কোজি অ্যাপারেলস (৮৬০ কোটি) এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, যার মোট পাওনা ৭৫০ কোটি থেকে ৮৯০ কোটি টাকার মধ্যে।
সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ বের করেছেন। এই ব্যাংক থেকে তাঁর নেওয়া বেশির ভাগ ঋণই ছিল বেনামি। এত দিন তাঁর নামে জনতা ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেখিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তাঁর ২৯ প্রতিষ্ঠানে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ২১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার ঋণের তথ্য বেরিয়ে আসে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা সাবেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল জব্বার বলেন, ব্যাংক থেকে ক্ষমতার জোরে সব অনিয়ম করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ঋণ এখন খেলাপি দেখানো হয়েছে। গত আগস্টের আগে তা দেখানোর মতো পরিবেশ ছিল না। এ জন্য কোনো ব্যাংক মুখ খোলেনি।বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, একক গ্রাহককে মূলধনের ২৫ শতাংশের (ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড) বেশি ঋণ দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে জনতা ব্যাংক একটি গ্রুপকেই ব্যাংকের মূলধনের ৯৪৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ ঋণ-সুবিধা দিয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে জনতা ব্যাংকের মতোই বিপদে পড়েছে অন্যান্য ব্যাংকগুলোও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এবি ব্যাংকের বকেয়া পাওনা প্রায় ৮৯০ কোটি টাকা, যার মধ্যে ট্রপিক্যাল ফ্যাশন, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ও ইন্টারন্যাশনাল নিটওয়্যার অ্যান্ড অ্যাপারেলস লিমিটেডের কাছে পাওনা রয়েছে। বেক্সিমকো লিমিটেডের কাছে এবি ব্যাংকের ৪৯০ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৪২৫ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ৯৮৭ কোটি, ইউসিবির ৩৩৩ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ৪২০ কোটি ও এক্সিম ব্যাংকের ৪৯৭ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এছাড়া, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৩২০ কোটি, পদ্মা ব্যাংকের ২৩ কোটি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৬১ কোটি ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ৯৩ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন বলেন, ঋণের একটি নির্ধারিত সীমা রয়েছে, তবে কিছু ব্যাংক তাও উপেক্ষা করে আগ্রাসী ঋণ প্রদান করে। এটি স্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন। বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়মের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতিতে বিশ্বাস করে এবং কোনো অপরাধীকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনের আওতায় ব্যাংক লুটেরাদের বিচার করা হবে।
**বেক্সিমকো গ্রুপকে ঋণ দেওয়ার তথ্য জানতে চায় সরকার
**বেক্সিমকো গ্রুপের দেনা ৫০ হাজার কোটি টাকা
**বেক্সিমকোর ১৬ পোশাক কোম্পানি বিক্রি করবে সরকার