১১৩ টনের প্রাপ্যতায় ১,১১৩ টন আমদানি, ৯২৬ টন গায়েব

এনএইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড

** প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়ন কিছু নেই, তবুও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ৯২৬ মেট্রিক টন কাপড় খালাস করেছে
**এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা কন্টেইনার প্রতি দুই লাখ টাকা নিয়ে খালাস করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে
** ৯২৬ মেট্রিক টন কাপড় খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কমিশনারেট
** ৯২৬ মেট্রিক টনে শুল্ককর ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ৫৫ কোটি টাকা, প্রতিষ্ঠানের বিআইএন লক হচ্ছে

বন্ড সুবিধায় ১১৩ দশমিক ৯৭ মেট্রিক কাপড় আমদানিতে বন্ড কমিশনারেট প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়ন দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান আমদানি করেছে প্রায় ১ হাজার ১১৩ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন কাপড়। যার মূল্য প্রায় ৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, যাতে প্রযোজ্য শুল্ককর প্রায় ৫৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কোনো প্রকার প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়ন না যাচাই করেই এই বিপুল পরিমাণ কাপড় খালাস করেছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা প্রতি কন্টেইনারে দুই লাখ টাকা ঘুস নিয়ে কোন প্রত্যয়ন ছাড়াই এসব কাপড় খালাস করেছে। প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা বা প্রত্যয়ন ছাড়াই এই বিপুল পরিমাণ কাপড় খালাস করায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তদারকি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আবার প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা অনুযায়ী আমদানিযোগ্য ও আমদানি করা কাপড়ের পরিমাণ প্রায় ১৮৯ দশমিক ১০ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ৯২৬ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন কাপড় প্রতিষ্ঠানের থাকার কথা। বন্ড কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানের কাছে এই কাপড় নেই। এই পরিমাণ কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করে রপ্তানিও করা হয়নি। রাজস্ব ফাঁকি দিতে এই বিপুল পরিমাণ কাপড় প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠানের কাছে ইতোমধ্যে ৯২৬ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন কাপড় কোথায়, কিভাবে ব্যবহার হয়েছে-নাকি খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

এনবিআর সূত্রমতে, সাভার হেমায়েতপুর চলন্তিকা হাউসিং এলাকার তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এন এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেড। ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়নপত্র ছাড়াই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে ফ্রি অব কস্ট (এফওসি) সুবিধায় বিপুল পরিমাণ কাপড় খালাস নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। বন্ড সুবিধার এসব কাপড় বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও পান বন্ড কর্মকর্তারা। এছাড়া প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়ন ছাড়াই কিভাবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এই বিপুল পরিমাণ কাপড় খালাস করেছে-এমন অভিযোগ পাওয়ার পর বন্ড কমিশনারেট থেকে তা খতিয়ে দেখা শুরু করা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এন এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডকে সর্বশেষ চলতি বছরের ১৯ মার্চ শর্ত সাপেক্ষে ৯ ধরনের ১১৩ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন কাপড় খালাসের জন্য ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়। বন্ড কমিশনারেটে এই প্রতিষ্ঠানের ২০২৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষা মেয়াদে ২৫২ দশমিক ৭২ মেট্রিক টন তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বরের আদেশ অনুযায়ী, ২৫২ দশমিক ৭২ মেট্রিক টন তৈরি পোশাকে ব্যবহৃত কাঁচামাল বা কাপড়ের পরিমাণ প্রায় ২৯৫ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন।

এনবিআরের ২০২৫ সালের ২৯ মে ‘সরাসরি রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান (ওয়্যারহাউজ পদ্ধতির আওতায় সাময়িক আমদানি, ওয়্যারহাউজ পরিচালনা ও কার্যপদ্ধতি) বিধিমালা, ২০২৪’ এর বিধি-৭ অনুযায়ী, কোন প্রতিষ্ঠান বিগত নিরীক্ষা মেয়াদের ৫০ শতাংশ ফ্রি অব কস্ট বা এফওসি এর মাধ্যমে কাঁচামাল বন্ড সুবিধায় আমদানি করতে পারবে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অর্থাৎ রিভলভিং পদ্ধতিতে যদি ৫০ শতাংশের বেশি পণ্য এফওসি এর মাধ্যমে বন্ড সুবিধায় আমদানি করতে হয়। তবে সংশ্লিষ্ট বন্ড কমিশনারেটের প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে।

বন্ড কমিশনারেটের হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষা মেয়াদে এফওসির ভিত্তিতে আমদানিযোগ্য কাপড়ের পরিমাণ ১৪৭ দশমিক ৮৪ মেট্রিক টন। কিন্তু আমদানির তথ্য যাচাইয়ে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষা মেয়াদে ১ হাজার ১১৩ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন কাপড় এফওসি সুবিধায় আমদানি করেছে। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে বন্ড কমিশনারেট মাত্র ১১৩ দশমিক ৯৭ মেট্রিক টন কাপড় এফওসি সুবিধায় আমদানির অনুমতি বা প্রত্যয়নপত্র দিয়েছে। আর প্রতিষ্ঠানের ‘সেলস কন্ট্রাকের’ বিপরীতে অনুমোদিত ১১৩ দশমিক ৭১ মেট্রিক টনের মধ্যে ৩৯ দশমিক ২৬ মেট্রিক টন আমদানি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ২০২৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিরীক্ষা মেয়াদে এফওসি সুবিধায় আমদানিযোগ্য ১৪৭ দশমিক ৮৪ মেট্রিক টন ও প্রতিষ্ঠানকে দেয়া প্রত্যয়ন অনুযায়ী সেলস কন্ট্রাকের মাধ্যমে আমদানি করা ৩৯ দশমিক ২৬ মেট্রিক টনসহ মোট আমদানিযোগ্য বা আমদানি করা কাপড় ১৮৭ দশমিক ১০ মেট্রিক টন। প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ১ হাজার ১১৩ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন থেকে ১৮৭ দশমিক ১০ মেট্রিক টন কাপড় বাদ দিলে বাকি ৯২৬ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন কাপড় প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকার কথা।

অপরদিকে, প্রতিষ্ঠানটির এফওসি সুবিধায় আমদানি করা কাপড়ের হদিস না পাওয়ায় ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা ও প্রত্যয়নপত্র না নিয়ে কাপড় আমদানির বিষয়টির ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বিআইএন কেন স্থগিত করা হবে না তারও ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

এনবিআরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস বার্তাকে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ১১৩ দশমিক ৭১ মেট্রিক টন কাপড়ের মধ্যে ৯২৬ দশমিক ৬১ মেট্রিক টন কাপড় বন্ড সুবিধায় আমদানি করতে বা প্রাপ্যতা বা প্রত্যয়ন নিতে বন্ড কমিশনারেটে কোন আবেদন করেনি। এমনকি এই কাপড়ের কোন সেলস কন্ট্রাকও দেখাতে পারেনি। এই কাপড় প্রতিষ্ঠান খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা বন্ড কমিশনারেটের কোনো প্রাপ্যতা বা প্রত্যয়ন যাচাই না করেই ১১৭টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা প্রায় ৬১ কোটি টাকার কাপড় ছেড়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যাতে শুল্ককরের পরিমাণ প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। এফওসি সুবিধার কাপড় হলেও প্রাপ্যতা বা প্রত্যয়ন-যেকোন একটা অনুমতি ছাড়া কিভাবে কাপড় খালাস করা হয়েছে! একজন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তার নেতৃত্বে খালাস হয়েছে, প্রতি কন্টেইনারে দুই লাখ টাকা ঘুস নিয়ে কোন কাগজপত্র যাচাই ছাড়াই খালাস হয়েছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। বিষয়টি বন্ড কমিশনারেট ও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস খতিয়ে দেখতে পারে।

অপরদিকে, কাপড় খালাসে অনিয়ম, খোলাবাজারে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকার করেন এন এইচ অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমা সুলতানা। প্রত্যয়ন ছাড়াই ৯২৬ মেট্রিক টন আমদানির বিষয়ে নাজমা সুলতানা বিজনেস বার্তাকে বলেন, আমাদের যে প্রাপ্যতা ছিলো, সে অনুযায়ী আমরা আমদানি করেছি। আমাদের বার্ষিক অডিট হয়নি। অডিট হলে দেখা যাবে, আমরা যে প্রাপ্যতা পাই, সে পরিমাণ আমদানি করা হয়েছে। বন্ড কমিশনারেট অডিটের আগের হিসাব নিয়েছে। অডিটের পরে যে প্রাপ্যতা, সেটার হিসাব তারা নেয়নি। সে অনুযায়ী মাল আমাদের শিপমেন্টও হয়ে গেছে। আমাদের এখনো এক বছরের অডিট হয়নি। দুই বছরের অডিট অনুযায়ী আমরা যে প্রাপ্যতা পাই, সে অনুযায়ী আমরা এই কাপড় আমদানি করেছি। এই বছর অডিট হলে আমরা আরো ডাবল প্রাপ্যতা পাবো। মাত্র ১১৩ মেট্রিক টনের প্রত্যয়ন নিয়ে ১ হাজার ১১৩ মেট্রিক টন আমদানির বিষয়টি এড়িয়ে যান নাজমা সুলতানা। খোলাবাজারে বিক্রির বিষয়টি অস্বীকারও করেন তিনি। বলেন, ৯২৬ টন ব্যবহার হয়েছে। শিপমেন্টও হয়ে গেছে।

** নতুন চার কাস্টম হাউস ও আট ভ্যাট কমিশনারেট হচ্ছে
** ৫২০ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকিতে অর্থদণ্ড ৪৯ কোটি টাকা
** আব্দুল মোনেম সুগার ও দুই পরিচালকের ব্যাংক হিসাব জব্দ
** ৪২২ কোটি টাকার শুল্ককর না দিয়ে পালিয়েছেন ৮ মালিক
** অনলাইনে মিলছে ‘বন্ড লাইসেন্স’
** ১৪৫ টন বন্ডের কাপড় গোডাউনে ঢুকেনি, সড়ক থেকে ‘হাওয়া’
** টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস হয় বন্ডের কাঁচামাল!
** প্রিয়াংকা ফ্যাশন: বন্ডের কাঁচামাল আছে, কাঁচামাল নেই
** ৩০১ টন বন্ডের কাঁচামাল গায়েব করেছে ‘জেএফকে ফ্যাশন’
** এইচএস কোডের চার ডিজিট মিল থাকলে খালাস করতে হবে
** এইচএস কোড ভিন্ন হলেও পণ্য খালাসে জটিলতা নেই
** রপ্তানি না করেও পাচ্ছে প্রাপ্যতা-ইউপি, বিক্রি করে এলসি
** প্রাপ্যতা জালিয়াতি, এমডি-চেয়ারম্যানের নামে মামলা
** ঝুঁকিপূর্ণ ৮৩ বন্ড প্রতিষ্ঠানই অনিয়মে ‘ভরপুর’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!