আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন বিদেশি ফলে শুল্ক ও করের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের পাশাপাশি অগ্রিম কর ও অগ্রিম ভ্যাটও বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ সংযোজন হিসেবে ফল আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন ১০০ টাকার ফল আমদানি করলে ১৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়। সম্প্রতি ট্যারিফ কমিশনের এই প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয়। সেখানে বিদেশি ফল আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন বিদেশি ফল বন্দরে পৌঁছানোর পরই ১০০ টাকার ফলের দাম বেড়ে হয় ২৩৬ টাকা। এরপর পরিবহন খরচসহ অন্যান্য ব্যয় যুক্ত হয়ে এই দাম আরও বাড়ে, যার চাপ পড়ে ভোক্তার ওপর। রমজানে এসব ফলের চাহিদা বাড়লেও অতিরিক্ত শুল্ক-করের কারণে এবার আমদানি কমে গেছে।
শুল্ক কর কত
বর্তমানে ফল আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ৩০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ১০ শতাংশ অগ্রিম কর, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর আছে। মোটামুটি যত ধরনের শুল্ক-কর আছে, সবই আরোপ করা হয়েছে বিদেশি ফল আমদানির ক্ষেত্রে। সব মিলিয়ে শুল্ক-কর ভার ১৩৬ শতাংশ।এনবিআর সূত্রে জানা যায়, প্রচলিত আমদানি পণ্যের মধ্যে গাড়ি ও মদ-সিগারেটের পর তাজা ফল আমদানিতেই সবচেয়ে বেশি শুল্ক-কর দিতে হয়।
শুল্ক-করের চাপ বেড়ে চলেছে
গত মাসে আমদানি করা আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টা, বাদামসহ বিভিন্ন ফলে সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এর আগে, ২০২২ সালের মে মাসে ডলার–সংকটের কারণে ফল আমদানিতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসায় সরকার, যাতে আমদানি নিরুৎসাহিত হয়। তবে আমদানিকারকদের দাবি, সাধারণত জরুরি অবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশেষ পরিস্থিতিতে এ ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়। অথচ বর্তমানে তেমন কোনো সংকট না থাকলেও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বহাল রয়েছে। ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি ২০২৩–এ বলা হয়, শুধু জরুরি প্রয়োজনেই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানো যেতে পারে। কিন্তু ফল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন।
মূল্য সংযোজন নেই, কিন্তু ভ্যাট আছে
বিদেশি ফল আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আগাম কর দিতে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিদেশি আপেল, আঙুর, নাশপাতি, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি ফল যে কার্টনে আসে, তা শুল্কায়নের পর সেভাবেই বাজারে আসে। ফলে খুব বেশি মূল্য সংযোজনের সুযোগ নেই। অথচ ভ্যাট দিতে হয়।
এ বিষয়ে তাজা ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আপেল, কমলা, নাশপাতি, মাল্টা এসব আর বিলাস পণ্য নয়। রোগীর পথ্য হিসেবে যেমন ব্যবহার হয়, তেমনি পুষ্টিমান নিশ্চিত করতেও ফল বেশ চলে। পবিত্র রমজান মাসেও ফলের বেশ চাহিদা থাকে। তাই এসব ফলের ওপর আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর কমানো উচিত।তিনি আরও বলেন, দেশে আপেল, নাশপাতির মতো বিদেশি ফল উৎপাদন হয় না বললেই চলে। দেশীয় পণ্য সুরক্ষা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই এত শুল্ক-কর আরোপ করার যুক্তি নেই। শুল্ক–কর বেশি হওয়ায় চোরাই পথে ফল আমদানি বেড়ে গেছে।
তাজা ফল বিলাস পণ্য নয়
তাজা ফলকে বিলাস পণ্য হিসেবে মনে করে না ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৫৬ সালের এসেনশিয়াল কমোডিটিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী, তাজা ফল একটি ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’। ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেন, আপেল, নাশপাতি, আঙুর, মাল্টা ও কমলা এখন আর বিলাস পণ্য নয়, বরং রমজানে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকে এবং চিকিৎসকেরাও রোগীদের এগুলো খাওয়ার পরামর্শ দেন। তাই এসব ফলের ওপর শুল্ক-কর কমানো প্রয়োজন। সম্প্রতি আমদানি করা ফলের শুল্ক-কর হ্রাসের জন্য এনবিআরকে সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। প্রস্তাব অনুযায়ী, সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ, অগ্রিম কর ১০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ করা এবং ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ৫ শতাংশ আগাম কর বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
কমেছে আমদানি
বর্তমানে বিদেশ থেকে ৩৮ ধরনের ফল আমদানি হয়। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আপেল আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৫১ শতাংশ, মাল্টা ৭০ শতাংশ, আঙুর ২৯ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে গত জানুয়ারিতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে মেন্ডারিন ৫১ শতাংশ, আঙুর ২১ শতাংশ, আপেল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, নাশপাতি ৪৫ শতাংশ, আনার ও ড্রাগনের ৩২ শতাংশ আমদানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়।এনবিআরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার বিদেশি ফল আমদানি হয়েছে। এসব ফল আমদানি থেকে সরকার রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা।
**শুল্ক না কমালে ফল আমদানি বন্ধের হুমকি
**বেনাপোল দিয়ে দুইদিনে ফল এসেছে ১২০ ট্রাক