জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক: করসেবা সহজ ও অটোমেশন করতে কাজ করছে এনবিআর। এতে করদাতার ভোগান্তি কমবে, সময় বাঁচবে। নিশ্চিত হবে স্বচ্ছতা। বর্তমানে অনলাইন যোগাযোগের ক্ষেত্রে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে হোয়াসঅ্যাপ। এতে দ্রুত মেসেজ, ছবি ও ভয়েস মেসেজ প্রেরণ করা যায়। আর এই হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে করসেবা দিচ্ছে কর অফিস। কর অঞ্চল রংপুর ও কর অঞ্চল-৫, ঢাকা হোয়াটসঅ্যাপে করসেবা দিচ্ছে। এনবিআরের মাঠ পর্যায়ে এই দুটি অফিস হোয়াটসঅ্যাপে করসেবা প্রদানে ইনোভেশনের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
এনবিআর প্রথমবারের মতো এ দুটিসহ মোট সাতটি ইনোভেশনের জন্য সম্মাননা ও ক্রেস্ট দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দুটি কর অঞ্চল, আপিল ট্রাইব্যুনাল, এনবিআরের শুল্ক ও অব্যাহতি শাখা, কাস্টমস বন্ড ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেট। সাতটি ইনোভেশনের মধ্যে ‘ডিজিটাল অফিস ব্যবস্থাপনা, নতুন করদাতা উদ্ঘাটন ও করজাল সম্প্রসারণ, করদাতার সময় ও অর্থ সাশ্রয়, সময় সাশ্রয়, করদাতাদের তথ্য আদান, উৎসে কর্তনকারী করদাতাদের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদান, ডিজিটাল ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড ব্যবস্থাপনা’ সুফল পাওয়া যাচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার আগারগাঁও এনবিআরের মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত ‘ইনোভেশন শোকেসিং, ২০২৩’ অনুষ্ঠানে এই সম্মাননা ও ক্রেস্ট দেয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মাকসুদ কামাল। সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, এনবিআর বর্তমান ইনোভেশন টিমের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ের সকল দপ্তরের উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দিতে আগস্ট মাসে ২০২২-২৩ সালের উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডের বিবরণ পাঠাতে অনুরোধ করা হয়। মাঠ পর্যায়ের দপ্তরের পাঠানো উদ্ভাবনীর মধ্যে সাতটি উদ্ভাবনী উদ্যোগকে নৈতিকতা কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত সাতটি ইনোভেশন হলো-বাংলাদেশ কাস্টমস অফিস ম্যানেজমেন্ট (বিকম)। এই ইনোভেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেনাপোল কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার ও বর্তমানে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা (উত্তর)-এর কমিশনার মো. আজিজুর রহমান। প্রধান উদ্যোক্তা বেনাপোল কাস্টম হাউসের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার ও বর্তমানে এনবিআরের প্রথম সচিব ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম। সেকেন্ডারি সোর্স হতে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে করদাতা শনাক্তকরণ। এই উদ্যোগের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কর অঞ্চল-৮, ঢাকার কমিশনার মোহাম্মদ আবুল মনসুর।
অনলাইনে আপিল, টাইব্যুনাল, এডিআর ও হাইকোর্টের ফি প্রদান সহজীকরণ। এই উদ্যোগের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কর আপিল-৩, ঢাকার যুগ্ম কমিশনার আরিফুল হক। শতভাগ ডি নথি বাস্তবায়ন শাখা: শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প সুবিধা। এই ইনোভেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এনবিআর সদস্য হোসেন আহমেদ ও উদ্যোক্তা ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম। হোয়াটসঅ্যাপ অ্যানাউচমেন্ট গ্রুপের মাধ্যমে করদাতাদের করসেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান। এই ইনোভেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কর অঞ্চল রংপুরের উপকর কমিশনার এসএম গালিব ফারুক। ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং (আইএম) প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে আইনি পরিপালনজনিত সেবা প্রদান। এই ইনোভেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক কর অঞ্চল-৫, ঢাকার কমিশনার আবু সাঈদ মো. মুস্তাক। ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেম। এই ইনোভেশনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সাবেক কমিশনার ও বর্তমানে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেটের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান।
অনুষ্ঠানে বলা হয়, বিকম বেনাপোল কাস্টম হাউসের উদ্ভাবন করা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। এর মাধ্যমে অফিস ব্যবস্থাপনার ২৪টি মডিউলকে অনলাইনে নিয়ে আসা হয়েছে। এই মডিউলগুলোর মাধ্যমে হাউসের কার্যক্রম আগের থেকে অনেক সহজ হয়েছে। অনলাইনে সম্পন্ন হওয়ায় ডেটা ম্যানেজমেন্ট আরও আধুনিক ও নিরাপদ হয়েছে। প্রতিটি কাজেই পূর্বের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে কম সময় লাগছে। এতে দপ্তরের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে রাজস্ব সুরক্ষা ও আদায় বাড়ছে। কর অঞ্চল, ঢাকা সেকেন্ডারি ডেটা ব্যবহার করে নতুন করদাতা শনাক্তকরণের উদ্যোগের মাধ্যমে অনেক নতুন করদাতা শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে সারাদেশে এই উদ্যোগ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রচুর নতুন করদাতা শনাক্ত ও করজাল সম্প্রসারণ সম্ভব হবে। কর আপিল-৩, ঢাকা অনলাইনে আপিল, ট্রাইব্যুনাল ও এডিআরের ফি প্রদান সহজীকরণ উদ্ভাবন করে। আপিলের ফি ২০০ টাকা দিতে গিয়ে করদাতাদের ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতে হয়। এই উদ্ভাবনের ফলে এখন অনলাইনে এ-চালান সিস্টেম থেকে বিকাশ, নগদ প্রভৃতির মাধ্যমে এই ফি দেয়া যাচ্ছে। এনবিআরের শুল্ক অব্যাহতি ও প্রকল্প শাখায় শতভাগ ডি নথি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গত দুই বছর ধরে নথি ই-ফাইলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে; যার মাধ্যমে সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ এর স্মার্ট অফিস ম্যানেজমেন্টের বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে।
আরও বলা হয়, কর অঞ্চল রংপুরে সার্কেলে নিবন্ধিত করদাতাদের ‘হোয়াটসঅ্যাপ অ্যানাউন্সমেন্ট গ্রুপ’-এর মাধ্যমে করষেবা সম্পর্কিত তথ্য অবহিত করা হচ্ছে। পূর্বে এসএমএসের মাধ্যমে করা হতো। এসএমএসের মাধ্যমে সাধারণত ২৫০ শব্দের মাধ্যমে পাঠানোর সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপের এই গ্রুপের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। এতে মেসেজ ছাড়াও ছবি সংবলিত লিফলেট, মাল্টিমিডিয়া সহজে পাঠানো যায়। এই ইনোভেশনের মাধ্যমে করদাতাদের রিটার্ন প্রদানে উদ্বুদ্ধ, অগ্রিম কর প্রদানে উৎসাহিত করা, আয়কর আইন না মানলে কী শাস্তি হবে-সে বিষয়ে সচেতনতামূলক তথ্য পাঠানো হচ্ছে। কর অঞ্চল-৫, ঢাকার উদ্যোগে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং (আইএম)’ প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে আইনি পরিপালনজনিত সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এতে আয়কর আইন সম্পর্কে করদাতাদের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দেয়া হচ্ছে। ফলে করদাতাদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। এতে উৎসে কর কর্তনের ইটিডিএস সিস্টেমের রেজিস্ট্রেশন বেড়েছে। ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড অটোমেশন সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট (বর্তমানে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট, ঢাকা দক্ষিণ)। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে শুল্ক অব্যাহতিতে আমদানি করা মদ জাতীয় পণ্যের ইনবন্ড ও এক্সবন্ড শতভাগ স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ওয়্যারহাউসের প্রাপ্যতার বেশি আমদানি করা রোধ হয়েছে। ওয়্যারহাউসভিত্তিক বিভিন্ন রিপোর্ট প্রস্তুত করা ও দ্রুততম সময়ে অডিট সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘আমরা চতুর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনের যুগে বসবাস করছি। আমরা খুব দ্রুত গতিতেই পঞ্চম ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভুলেশনে যাব। যেখানে মানুষ ও মেশিনের মধ্যে আরও বেশি পরিমাণে সংযোগ থাকবে। ইনোভেশন হলো মানুষের জীবনকে সহজতর করা। যেখানে পেপার ওয়ার্ক যত বেশি, তদবির তত বেশি, স্বচ্ছতা তত কম। ইনোভেশন, ডিজিটাইজেশন একদিকে নিশ্চিত করে স্বচ্ছতা, আরেক দিকে নিশ্চিত করে মানুষের জীবনের স্বাভাবিক গতি। তিনি বলেন, ইনোভেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের একটি অংশ। এনবিআর যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের সমস্যা বললে কিছু কনসেপ্ট দিতে পারবে। এখান থেকে এনবিআর কোনটা ইনোভেশন নিয়ে যাবেন। সেখান থেকে স্টার্টঅ্যাপ হতে পারে। পরবর্তী যা ইউনিকর্ন পর্যন্ত হতে পারে। ভারতের উদাহরণ দিয়ে উপাচার্য বলেন, ভারত গত কয়েক বছর আগ থেকে কাজটি করে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো ইউনিকর্ন আছে। স্টার্টআপ পার হয়ে সেগুলো এখন মিলিয়ন স্কেলের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। তিনি এনবিআর কর্তৃপক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করেন। সমস্যাগুলো যদি চিহ্নিত করে আমাদের বলে দেন, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীদের দিয়ে কিছু ক্রিয়েটিভ কনসেপ্ট তৈরি করে দিতে পারব। যেখান থেকে পরবর্তীতে ইনভেনশন ও ইনোভেশনে যেতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইনোভেশন বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন-এনবিআর সদস্য গ্রেড-১ (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) মো. মাসুদ সাদিক, সদস্য (কর প্রশাসন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) সৈয়দ মোহাম্মদ আবু দাউদ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন গবেষণা ও পরিসংখ্যান অনুবিভাগের মহাপরিচালক ইসমাইল হোসেন সিরাজী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এনবিআরের প্রথম সচিব ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে সাতটি ইনোভেশনের পৃষ্ঠপোষক ও উদ্যোক্তাদের সম্মাননা ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে এনবিআর, ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর বিভাগের সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।