হোটেল রয়েল টিউলিপের শেয়ারে ভয়াবহ কারসাজি

** রয়েল টিউলিপ শেয়ারে সাড়ে সাতগুণ বৃদ্ধি
** ৮ ব্রোকারেজ, ৫০ বিও অ্যাকাউন্টে কারসাজি
** লুৎফুল গনি টিটুর নেতৃত্বে শেয়ার চক্র
** কৃত্রিম সংকট-গুজবে বাড়ানো হয় দাম
** বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্টে অর্থনীতিবিদদের উদ্বেগ

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হোটেল রয়েল টিউলিপের সী পার্ল শেয়ারের দামে বড় ধরনের কারসাজি হয়েছে। গত বছরের ২০ জুলাই যেখানে প্রতি শেয়ারের দাম ছিল ৪৪ টাকা, চলতি বছরের ৯ মার্চ তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০ টাকায়। অর্থাৎ মাত্র সাড়ে সাত মাসে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শেয়ারের দাম সাড়ে সাতগুণ বাড়ানো হয়েছে।

৮টি ব্রোকারেজ হাউজের ৫০টি বিও অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এ কারসাজি চালানো হয়েছে। এর মূল নেতৃত্বে ছিলেন মো. লুৎফুল গনি টিটু, সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন মো. আবদুর রউফ মিয়া। কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে এবং বিভিন্ন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে তারা শেয়ারের দাম বাড়িয়েছেন। বর্তমানে গ্রুপটি শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে সরে যাচ্ছে। দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসব তথ্য মিললেও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সার্ভিল্যান্সে এখনো তা ধরা পড়েনি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, শেয়ারবাজারের নামে এটি আসলে জুয়া খেলা। তাদের পরামর্শ, বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) জানিয়েছে, এ ঘটনায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম শনিবার বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে যেকোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনকে তারা স্বাগত জানান। এ ধরনের প্রতিবেদনে বাজারসংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে তা খতিয়ে দেখা হবে। তিনি জানান, যদি কেউ আইন ভঙ্গ করে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে, তবে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারমূল্যের অস্বাভাবিক ওঠানামা কমিশনের নজরে এসেছে এবং সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে ফ্লোর প্রাইস থাকা সত্ত্বেও কিছু শেয়ারে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ পরিকল্পিতভাবে বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হবে। প্রমাণ মিললে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

রয়েল টিউলিপ ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। তালিকাভুক্তির সময় ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের শেয়ার ৫ টাকা প্রিমিয়ামসহ ১৫ টাকায় ইস্যু করা হয়েছিল। প্রথম দুই বছর সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ারের দাম ৪০ টাকার নিচেই লেনদেন হয়েছে। তবে তৃতীয় বছর, অর্থাৎ ২০২২ সাল থেকে শেয়ারের দামে অস্বাভাবিক উল্লম্ফন শুরু হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রয়েল টিউলিপের শেয়ারের অস্বাভাবিক লেনদেনে সরাসরি জড়িত ছিল ৮টি ব্রোকারেজ হাউজ—এসসিএল সিকিউরিটিজ, এরেনা সিকিউরিটিজ, শেলটেক সিকিউরিটিজ, মিকা সিকিউরিটিজ, ট্রাস্ট ব্যাংক সিকিউরিটিজ, প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক সিকিউরিটিজ এবং ইস্টার্ন ব্যাংক (ইবিএল) সিকিউরিটিজ। এসব লেনদেনের নেতৃত্ব দেন লুৎফুল গনি টিটো। তাঁর নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি ৮টি ব্রোকারেজ হাউজে ২৫ নাম ব্যবহার করে ৫০টির বেশি বিও অ্যাকাউন্ট খুলেছিল।

যেসব নামে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এগুলো হলো সাত রং অ্যাগ্রো ফিশারিজ লিমিটেড, পূর্ব রাজাবাজার সমবায় সমিতি, বন্ধু খাড্ডো বান্দার, নাসরিন রহমান, মাহমুদা আক্তার মুক্তা, ফারজানা হোসেন আলো, মো. আবদুর রউফ মিয়া, রাজিব হোসেন, বিএম আলম সিদ্দিক, লুৎফুল গনি টিটো, মো. আবু তাহের শিকদার, রুনি আক্তার, কামরুল হাসান মো. ইকবাল গনি, কবির ট্রেডার্স, বীমা রানী দাস, রাজশ্রী দাস, সরকার অ্যাগ্রো ফার্ম, হাসান নার্সারি, আমানত অ্যাগ্রো ফিশারিজ, মুক্তা ফিশারিজ, হৃদয় পোলট্রি ফার্ম ৬, আলম পোলট্রি ফার্ম, বিদাশিয়া অ্যাগ্রো ফার্ম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, সাব্বির স্টোর এবং মো. আবু নাঈম। এর মধ্যে ২১টি অ্যাকাউন্টে সবচেয়ে বেশি শেয়ার লেনদেন হয়েছে। অ্যাকাউন্টগুলো হলো ১২০১৫৭০০০০০০০৯৫৩, ১৬০৪৬৫০০৬১৭১৯৯০৩, ১২০৪৩৪০০৬৮৬৩০৪২৭, ১২০৩২৬০০৬৭০৮১২৮৫, ১২০১৭৩০০৩৯৪৯৭০৩৬, ১৬০২১৭০০৬৬১০৫৯২১, ১২০২৮৫০০০৩৭৭২৪৭৫, ১২০৫৫৯০০৭৫৫৭৬৩৮৫, ১২০১৫৭০০৭৪২৩৪৩৯২, ১২০১৫৭০০৭৪২৩২৪১৭, ১২০১৫৭০০৭৪২৩২১৫২, ১২০১৫৭০০৭৪২৩১৬৯৬, ১২০১৫৭০০৭৪২৩২৫১৬, ১২০১৯৫০০৬৪৮৪৫৫৫০, ১২০১৭৪০০৫৮৫৭৭৭৫৫, ১২০১৯৫০০৭৫৩৮৪৭৫৮, ১২০১৫৭০০৭৩৭৬০১৭৮, ১২০১৫৭০০৭৩৬১১৪৭১, ১২০১৫৭০০৭৪২৩২৭০৬, ১২০১৫৭০০৭৩৬৬০৮৭৮ ও ১২০১৭৫০০৭৪২৩২৭০। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে এক হাউজ থেকে শেয়ার কিনেছেন একই ব্যক্তি আবার অন্য হাউজ থেকে একই সময় বিক্রি করেছেন।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, রয়েল টিউলিপের মোট ১২ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তাদের দখলে রয়েছে ৫৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯০০ শেয়ার। ২০২২ সালের ২০ জুলাই কোম্পানির শেয়ারদর ছিল ৪৪ টাকা, তখন কোম্পানির বাজারমূলধন দাঁড়ায় ৫৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের এ কোম্পানিটি সে সময় ৫৩১ কোটি টাকায় কেনা সম্ভব ছিল।

কিন্তু মাত্র সাড়ে সাত মাসের মধ্যে, ২০২৩ সালের ৯ মার্চ প্রতি শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৩২০ টাকায়। ওইদিন কোম্পানির বাজারমূলধন দাঁড়ায় ৩৮৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে শেয়ারের দাম সাড়ে সাতগুণ বেড়ে যায়। অস্বাভাবিক লেনদেনের মাধ্যমে শুরুতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয় এবং নানা গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কেনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। এভাবেই শেয়ারের দাম ক্রমে বাড়ানো হয়। তবে দাম ওঠানামার খেলায় যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, তারা বিভিন্ন পক্ষের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছে। এমনকি কেউ যদি মাঝপথে বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করতে চাইত, তবে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে তার অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে।

বড় বিক্রেতাদের নানা পক্ষের মাধ্যমে হুমকি দেওয়া হয় এবং দাম বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বাজারে গুজব ছড়ানো হয় যে রয়েল টিউলিপের শেয়ার ৫০০ টাকায় পৌঁছাবে। এ গুজবে প্রভাবিত হয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই গুজব ছড়ানো হয়, ফলে লেনদেন আরও বাড়ে। তবে ৫০০ টাকার গুজব বাস্তবায়িত না হওয়ায় শেয়ারের দাম ৩২০ টাকায় ওঠার পর কারসাজিচক্র পিছু হটে। এরপর শেয়ার বিক্রি বাড়তে থাকে এবং দাম হঠাৎ নেমে শেয়ারটির দরপতন শুরু হয়। সর্বশেষ, কোম্পানির শেয়ার দাম ১৮২ টাকায় নেমে এসেছে। ফ্লোর প্রাইস থাকা সত্ত্বেও অস্বাভাবিক বিক্রির চাপ অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ জানান, শুধু রয়েল টিউলিপ নয়, আরও কয়েকটি কোম্পানিতেই এমন ঘটনা ঘটছে। ফ্লোর প্রাইস থাকায় সাধারণ বাজার কার্যকর না হওয়ার সময় জুয়াড়িরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে, যার ৯০ শতাংশই জুয়াড়িদের। বড় ও ছোট উভয় ধরনের জুয়াড়িই এ কাজ করছে। এদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করা না হলে বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি পাবে না।

আলোচ্য সময়ে কোম্পানির উদ্যোক্তাদের মধ্যে কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করেছেন। কোম্পানির উদ্যোক্তা বেঙ্গল ভ্যাকেশন ক্লাবে রয়েছেন চেয়ারপারসন লাকী আখতারী মহাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুল হক এবং পরিচালক একরামুল হক। গত বছরের ২৩ অক্টোবর তারা নিজ কোম্পানির ২০ লাখ শেয়ার কিনেছিলেন। এরপর ২৪ নভেম্বর ১৫ লাখ ২৬ হাজার ৬৫৩ শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন এবং ২৭ নভেম্বর আরও ২৮ লাখ ১৬ হাজার ৮৬০ শেয়ার বিক্রি করার ঘোষণা দেন। অর্থাৎ উদ্যোক্তারাও বাড়তি দামের সুবিধা নিয়েছেন। রয়েল টিউলিপ ২০১৯ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। সেই বছর বিনিয়োগকারীদের ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেওয়া হয় এবং পরবর্তী বছরে মাত্র ১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়।

রয়েল টিউলিপ সী পার্লের কোম্পানি সেক্রেটারি আজহারুল মামুন শনিবার বলেন, শেয়ারের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বাজারের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তার মতে, কোম্পানির কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল গোপন তথ্য নেই। সব তথ্য তারা নিয়মমাফিক বিএসইসিকে জানিয়ে থাকে। কোম্পানির আয় বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে দুই বছর আমাদের আয় অনেক কমেছিল, বর্তমানে পুরো সক্ষমতা কাজে লাগানো হচ্ছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!