হাজার কোটি টাকার আয় গোপন, করফাঁকি শত কোটি!

এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড

কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ, ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ও প্রকৃত ব্যাংক স্থিতিতে অর্থের পরিমাণ কম দেখানো, স্থায়ী সম্পদের তথ্য, ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়ের তথ্য গোপন—কোম্পানি এবং কোম্পানির মাধ্যমে পাওয়া অর্থ প্রাপ্তির প্রকৃত তথ্য গোপনে পটু এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড কোম্পানির মালিকেরা। আর এভাবেই এই কোম্পানিটির মালিকেরা ৭ বছরে অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। তাই সিকিউরিটি সার্ভিসের আড়ালে অবৈধ সম্পদ ব্যবস্থাপনার আশঙ্কা করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এসব লুকোছাপায় কর ফাঁকি ছাড়াতে পারে শত কোটি টাকা—অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর গোয়েন্দা বিভাগের অগ্রগতি প্রতিবেদনে এমনটাই উঠে এসেছে।

জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশে বহুল পরিচিত সিকিউরিটি সার্ভিস হলো এলিট সিকিউরিটি ফোর্স। ব্যাংকসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা কর্মী সরবরাহ করে কোম্পানিটি। ঢাকার কারওয়ান বাজারে তেমনি দুজন নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, দৈনিক ন্যূনতম ৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সেবা নেওয়া প্রতিষ্ঠানের ধরন অনুযায়ী ন্যূনতম বেতন ৮ থেকে ১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। আবার বেশিরভাগ কর্মী ওভারটাইমও করেন।

অপরদিকে, কোম্পানির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এলিট ফোর্সে ২০২৩ সালে প্রহরীর (গার্ড) সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৫০০ জন। একজন কর্মী যদি মাসে গড়ে ১০ হাজার টাকা মজুরিও পান, তাহলে কোম্পানির মোট মাসিক মজুরি ব্যয় দাঁড়ায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা। বছরে দাঁড়ায় ২৭০ কোটি টাকা। গার্ডদের বেতন ছাড়াও কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, তিনটি ট্রেনিং একাডেমির ব্যবস্থাপনা ব্যয়, ১৫ থেকে ২০টি ডগ স্কোয়াডের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়সহ নানা ধরনের ব্যয় আছে কোম্পানিটির। সব মিলিয়ে কয়েকশ’ কোটি টাকা হওয়ার কথা। এসবের বিপরীতে আয় আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু ২০২৩-২৪ করবর্ষে কোম্পানিটি আয় দেখিয়েছে ১৩৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ব্যয় দেখিয়েছে ১৩৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। মুনাফা দেখানো হয় ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যা কর্মীর সংখ্যা ও আয়ের হিসাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর এভাবেই গত ৭ বছরে ধারাবাহিকভাবে কম আয়-ব্যয় দেখিয়েছে কোম্পানিটি।

কোম্পানির ব্যাংক হিসাবের তথ্য গোপন

৭ বছরের আয়কর নথিতে এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড ৯টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিয়েছে। সব তফশিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে এ তথ্য যাচাই-বাছাই করে এনবিআরের কর গোয়েন্দা ইউনিট। সব মিলিয়ে সংস্থাটির দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, কোম্পানির প্রকৃত ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ৩৭টি। অর্থাৎ চার ভাগের তিন ভাগ ব্যাংক হিসাবের তথ্যই গোপন করা হয়েছে।

ব্যাংক হিসাব গোপন করে আয় গোপন

কর গোয়েন্দারা জানান, গোপন করা হিসাবগুলোতে নিয়মিত বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হতো। ৭ বছরে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ২১৭ কোটি টাকা। কিন্তু কোম্পানির আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৬১ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিভিন্ন হিসাবে ১ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য গোপন করেছে কোম্পানিটি।

স্থিতি গোপন

গত ৭ বছরে কোম্পানিটির ব্যাংক হিসাবে স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৯৯ কোটি টাকা। কিন্তু আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে ৪৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এসব স্থিতির বিপরীতে সুদও পেয়েছে কোম্পানিটি। অবশ্য সুদের তথ্যও গোপন করা হয়েছে। কর গোয়েন্দাদের হিসাবে, স্থিতি গোপন করে আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে সাড়ে ২২ কোটি টাকা। সুদ ও জরিমানাসহ যা আরও বেশি হবে।

স্থাবর সম্পদ গোপন

ঢাকার গুলশান, বারিধারা ও নদ্দা এলাকায় এলিট ফোর্সের কয়েকটি অফিস ও স্থাপনার সন্ধান পেয়েছে কর গোয়েন্দারা। তারা জানান, কোম্পানিটির তিনটি ট্রেনিং একাডেমি এবং একটি অফিস আছে। কিন্তু এসব একাডেমির তথ্য নেই আয়কর নথিতে। প্রতিটি একাডেমি প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এসব স্থাপনার বাজারমূল্য কয়েকশ’ কোটি টাকা। যা আয়কর নথিতে দেখানো হয়নি।

ব্যক্তিগত নথিতেও তথ্য গোপন

এলিট সিকিউরিটি ফোর্স লিমিটেড কোম্পানিটি একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শরীফ আজীজ। ১৯৯৯ সালে তিনি কোম্পানি শুরু করেন। তার স্ত্রী শরীফ সেনে সেমবিল, ছেলে শরীফ শামাম আল ওয়াফি, কন্যা শরীফ জুয়েনা জাইম কোম্পানির পরিচালক। শরীফ আজিজ ও শরীফ সেনে সেমবিল আয়কর নথিতে মাত্র ৩টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দুজনের নামে, একক ও যৌথ, তিনশর বেশি হিসাবের তথ্য পেয়েছেন কর গোয়েন্দারা। ব্যাংক হিসাব গোপন করে শরীফ সেনে সেমবিল ১৬১ কোটি টাকার এফডিআর গোপন করেছেন। এছাড়া ব্যাংকে বিভিন্নভাবে থাকা আরও ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা গোপন করেছেন তিনি। অন্যদিকে, শরীফ আজিজের গোপন করা ব্যাংক হিসাবে মিলেছে ২১৩ কোটি টাকার এফডিআরের তথ্য। এফডিআর ছাড়া আরও ছিল ৫৩ কোটি ২৬ লাখ টাকা।

স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সম্পদের পরিমাণ

এনবিআরে শরীফ আজিজ দম্পতির দাখিল করা ২০২৩-২৪ করবর্ষের আয়কর নথির তথ্যও পেয়েছে এই প্রতিবেদক। সবশেষ হিসাবে, শরীফ আজিজের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬ কোটি ৫ লাখ টাকা। এই করবর্ষে তিনি আয় দেখান প্রায় ৭৫ লাখ টাকা। কর দেন ১৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। শরীফ আজিজের স্ত্রী শরীফ সেনে সেমবিলের বৈধ সম্পদের পরিমাণ এখন ৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ করবর্ষে তিনি আয় দেখান ৬৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। কর দেন ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাড়ি, ফ্ল্যাট আছে এই দম্পতির।

স্বামী-স্ত্রীর কর ফাঁকি

আয়কর গোয়েন্দাদের হিসাবে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত ব্যাংক স্থিতি ও সুদ আয় গোপন করে বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়েছেন এই দম্পতি। শরীফ আজিজের ফাঁকির পরিমাণ ২৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা। শরীফ সেনে সেমবিলের ফাঁকির পরিমাণ ২২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। কর ফাঁকি নির্ণয়ে বিপুল পরিমাণ অপ্রদর্শিত ব্যাংক জমা বিবেচনা করেননি গোয়েন্দারা।

উল্টো কর ফেরত নিয়েছেন

এলিট সিকিউরিটি যেসব কোম্পানিকে গার্ড ও সেবা দেয়, সেসব কোম্পানি ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করে। বিল পরিশোধের সময় উৎসে কর কেটে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় ব্যাংকগুলো। যা পরবরতিতে নিট মুনাফা ও করের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। আয়কর গোয়েন্দাদের হিসাবে, গত ৭ বছরে উৎসে করের ৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এনবিআর থেকে ফেরত নিয়েছেন এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস। এর মধ্যে আড়াই কোটি টাকা কর সমন্বয় করা হয় ও বাকিটা চেকের মাধ্যমে ফেরত নেয় কোম্পানিটি।

এত টাকার উৎস কী

এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসের কর ফাঁকি তদন্ত শেষ করতে আরও সময় লাগবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে কর গোয়েন্দা ইউনিট। তবে এরই মধ্যে একটি সাময়িক প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, তদন্ত চলাকালে দফায় দফায় অভিযুক্তদের বক্তব্য নেওয়া হয়। তবে কোনো সদুত্তর মেলেনি। গোয়েন্দাদের ধারণা, গোপন করা সম্পদগুলো ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব অবৈধ সম্পদের মালিক বা এর সঙ্গে যোগসূত্র থাকতে পারে। তাদের খুঁজে বের করতে ব্যাংক হিসাবের তথ্য ধরে তদন্ত করা যেতে পারে বলে মনে করেন গোয়েন্দারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলিট সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শরীফ আজীজ এনবিআর কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছেন জানিয়ে বলেন, ফোন করার জন্য ধন্যবাদ। আমরা অভিযোগের বিরোধিতা করছি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ট্যাক্স ফাঁকি দিছি, আপনারা বলেন আমাদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাক। আমি যা বলছি তা প্রয়োজনে রেকর্ড করে মানুষকে শুনান! কোনো সমস্যা নাই।’

** মূল প্রতিবেদন-শত কোটি টাকার কর ফাঁকি দিতে লুকোছাপা, না নেপথ্যে বড় কোনো গড়বড়?

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!