আত্মগোপনে থাকা সাবেক মন্ত্রী ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ দুর্নীতির মাধ্যমে বিশাল পরিমাণে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গড়েছেন। তার পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে সম্পদের তথ্য দেখে চমকে উঠেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা।হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের টানা ১৬ বছরের শাসনামলে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় ২৪ এর জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্নগোপনে চলে যান।
ব্যাংক হিসাব তথ্যে দেখা যায়, ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ, তার স্ত্রী নুরান ফাতেমা, মেয়ে নাফিসা জুমাইনা মাহমুদ এবং তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ৭০টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া গেছে। এসব একাউন্ট থেকে প্রায় সাড়ে ৭ শত কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে, এবং বর্তমানে হিসাবগুলোতে ২৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা রয়েছে। এসব লেনদেন দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ঘটেছে, কিন্তু তাদের আয়কর ফাইলের তথ্যের সঙ্গে এসব সম্পদের গরমিল রয়েছে, যা আয়কর ফাইলের তথ্যের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার গুণ বেশি।
হাছান মাহমুদের স্ত্রী কন্যা ছাড়াও তার দু’ভাই এরশাদ মাহমুদ এবং খালেদ মাহমুদের নামেও বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়েছেন। তাদের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় জমি দখল, বন বিভাগের পাহাড় দখল, বাংলো বাড়ি ও বাগান বাড়ি নির্মাণ, পুকুর কেটে মৎস্য চাষ, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় অট্টালিকা ভবন ও ফ্ল্যাট এর মালিকানা, আবুধাবির আজমান এলাকায় বিশাল জায়গা নিয়ে রিসোর্ট তৈরির মতো বিভিন্ন অভিযোগ জমা হচ্ছে।
হাছান মাহমুদ ও পরিবারের সদস্যদের নামে অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান টিম। টিমের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে, উপ-পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উপ-পরিচালক কমলেশ মন্ডল, সহকারী পরিচালক আল আমিন, সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম। তারা দেশে ও দেশের বাইরে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে। যা যাছাই বাছাই করা হচ্ছে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাছান মাহমুদ মন্ত্রী থাকা অবস্থায় স্ত্রী নুরান ফাতেমাকে জাহাজ ব্যবসায়ী হিসেবে লাইসেন্স পেতে সহায়তা করেছেন। একটি কন্টেইনার জাহাজসহ দু’টি জাহাজ নির্মাণ করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের এক জাহাজ তৈরি প্রতিষ্ঠান এফএমসি গ্রুপ’র পক্ষ থেকে সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ এর স্ত্রী নুরান ফাতেমাসহ সাতজনের নামোল্লেখ করে ১৯জনের বিরুদ্ধে জাহাজ নির্মাণের চুক্তির টাকা পরিশোধ না করা এবং হামলার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করেছে। মামলায় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পানিতে জাহাজ ভাসানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক অনুসন্ধানকালে অভিযোগ পেয়েছে, হাছান মাহমুদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকাকালীন রাতারাতি নিজের স্ত্রীকে জাহাজের লাইসেন্স দিয়ে জাহাজ ব্যবসায়ী বানিয়ে দেন। জাহাজ তৈরির জন্য রূপালী ব্যাংক থেকে ১২ কোটি টাকা গ্রহণ করলেও তা পরিশোধ না করায় এখন সুদাসলে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা হয়েছে।
হাছান মাহমুদের একমাত্র কন্যা নাফিসা জুমাইনা মাহমুদের নামে ৩টি ব্যাংকে ৪টি একাউন্ট রয়েছে, যেখানে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে এবং ৯৬ লাখ টাকা জমা রয়েছে। নাফিসা, ‘দি ডেইলি পিপলস লাইফ’ নামক ইংরেজি দৈনিকের প্রকাশক, যা তার পিতা তথ্যমন্ত্রী থাকার সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ডিক্লারেশন নেয়। পত্রিকার নামে একটি ব্যাংক একাউন্টে ৭২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছে, কিন্তু আয়কর নথির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
দুদকের তদন্তে হাছান মাহমুদের নামে ছয়টি ব্যাংক একাউন্ট পাওয়া গেছে, যা মেঘনা ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক এবং এবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখায় খোলা হয়েছে। এই হিসাবগুলোর মধ্যে রয়েছে: এবি ব্যাংকের পোর্টকানেক্টিং শাখা (অ্যাকাউন্ট নম্বর- ৪১২৭-০৭১৬৬০২৮২), গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড় শাখা (অ্যাকাউন্ট নম্বর- ১১১১০০০৫৫৮৪৭৮ এবং ১১১১০০০০২৪৯২৩), মেঘনা ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা (অ্যাকাউন্ট নম্বর- ২১০১১২১০০০০১২৬৮, ২১০১৩০৫০০০০০৫৫৯), এবং মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের জুবলী রোড় শাখা (অ্যাকাউন্ট নম্বর- ০০১৮০৩৩০০০৮১৭৪)।
এছাড়াও হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমা’র নামে ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে ১১টি। কন্যা নাফিসা জুমাইনা মাহমুদের নামে চারটি, হাছান মাহমুদ ও স্ত্রী নুরান ফাতেমার যৌথ নামে দু’টি, নুরান ফাতেমা ও সালাহউদ্দিন যৌথ নামে একটি, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস’র ব্যবসায়িক পার্টনার দেখানো হয়েছে হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রী নুরান ফাতেমাকে। বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস’র নামে দু’জনের যৌথ একাউন্ট রয়েছে ১৯টি। মেসার্স বিসমিল্লাহ সার্ভিসেস’র নামে একাউন্ট রয়েছে আটটি, দি বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একাউন্ট পাঁচটি, মেসার্স বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস জে.এ.এস লি. নামে একটি, মেসার্স বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট এন্ড হোল্ডিংসের নামে ছয়টি একাউন্ট রয়েছে।
হাছান মাহমুদ তার সর্বশেষ নির্বাচনী হলফনামায় বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও দোকানভাড়া খাতে বছরে ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, কৃষিখাতে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা এবং ব্যাংক ও অন্যান্য খাত থেকে সম্মানী বাবদ ১ লাখ ২২ হাজার ২৬৩ টাকা আয় দেখিয়েছেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা বাদে তার বাৎসরিক আয় ২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বার্ষিক আয় ছিল ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এছাড়া, তিনি ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার ঋণ দেখিয়েছেন, যার মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ঋণ এবং ৯১ লাখ টাকা জামানত বিহীন ঋণ রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, হাছান মাহমুদের চট্টগ্রামের দেওয়ানবাজার এলাকায় ১৫ তলা সহ তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে। একই এলাকায় তার স্ত্রীর নামে একটি বহুতল ভবনও আছে। ঢাকার পিংক সিটিতে তিনটি বাড়ি এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়ও তার প্লট ও বাড়ি রয়েছে। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমানে একটি সম্পূর্ণ এলাকা কিনে সেখানে বাড়ি, হোটেলসহ বহু স্থাবর সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি। এছাড়া, চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (এফডিসি) পাশে শতকোটি টাকার একটি বাণিজ্যিক প্লটও তার নামে রয়েছে।
জানা গেছে,হাছান মাহমুদ ২০১৩ সালে মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণের জন্য রূপালী ব্যাংক থেকে ঋণ নেন, কিন্তু ১১ বছর ধরে এক টাকাও পরিশোধ করেননি। ঋণের পরিমাণ বর্তমানে সাড়ে ১৯ কোটি টাকা, এবং প্রভাব খাটিয়ে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন ও সুদ মওকুফ করেছেন। এদিকে, সরকার পতনের পর তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় তার স্ত্রী, দুই ভাই এবং আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, হাছান মাহমুদ ও তার স্ত্রীর মালিকানাধীন বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস চট্টগ্রামের এফ.এম.সি গ্রুপের সঙ্গে একটি কন্টেনার ও ফিশিং জাহাজ নির্মাণের চুক্তি করে। কিন্তু তারা কোনো ব্যয় না বহন করে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জাহাজগুলো ডেলিভারি নিয়ে নেয়। পরে, তারা জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারধর করে এবং অফিস ভাঙচুর করে ২ লাখ টাকা ক্ষতি সাধন করে।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাছান মাহমুদ বন ও পরিবেশ মন্ত্রী থাকাকালে রাঙ্গুনিয়ায় ২১২ একর বন বিভাগের জমি জোর করে দখল করে সেখানে বাগান বিলাস এবং গরুর খামার গড়ে তোলেন। সরকারের পতনের পর বন বিভাগ জমি পুনরায় দখল করে স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে। গত ১৬ জানুয়ারি আদালতের নির্দেশে তার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছে এবং অন্যান্য সম্পদ জব্দের বিষয়েও আদালতকে অবহিত করা হবে।