হকারদের দখলে ৪ হাসপাতালের প্রবেশপথ

আগারগাঁও-শ্যামলী সড়ক

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ সরণি এখন কার্যত হকারদের দখলে চলে গেছে। শ্যামলী, মিরপুর রোড ও আগারগাঁওয়ের সংযোগকারী এই সড়কের দুই পাশে রয়েছে দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান—জাতীয় শিশু হাসপাতাল, চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল এবং পঙ্গু হাসপাতাল। এ ছাড়া রয়েছে বহু সরকারি দপ্তর ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান।

তবে এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সামনে ফুটপাত তো বটেই, সড়কজুড়েই বসেছে হকারদের পসরা। ফুটপাতে জায়গা না পেয়ে অনেক হকার তাদের দোকান বসিয়েছেন মূল সড়কে। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে গোটা সড়কটি রূপ নিয়েছে একটি অস্থায়ী বাজারে। ফুটপাত এবং সড়কের দুই পাশজুড়ে বসানো কয়েক শ দোকানের কারণে হাঁটা তো দূরের কথা, চিকিৎসা নিতে আসা অসুস্থ রোগী ও তাদের স্বজনদের চলাচলও হয়ে পড়েছে চরম দুরূহ। অথচ কিছুদিন আগেও আগারগাঁও থেকে শ্যামলী পর্যন্ত এই সড়ক ছিল পরিচ্ছন্ন ও দৃষ্টিনন্দন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, হুইলচেয়ারে থাকা অনেক রোগীকে বাধ্য হয়ে সড়কের মাঝখান দিয়ে নেওয়া হয়, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এলাকাবাসী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এ এলাকায়ই বসবাস করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, যিনি প্রতিদিন এই সড়ক ব্যবহার করেন। তারপরও এখন পর্যন্ত কোনো উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়নি—এ নিয়ে তারা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দোকানের আকার অনুযায়ী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চাঁদা দিতে হচ্ছে। আগে একটি গ্রুপ চাঁদা নিত, এখন তা নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য আরেকটি গ্রুপ। শুধু তাই নয়, এই চাঁদার একটি অংশ যাচ্ছে প্রশাসনের কিছু সদস্যের পকেটেও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে পলিথিন দিয়ে ঘেরা রয়েছে জুতা, কাপড়, ফলমূল, খেলনা ও ওষুধসহ নানা ধরনের দোকান। যারা ফুটপাতে জায়গা পাননি, তারা ঠেলাগাড়ি ও ভ্যানগাড়ি নিয়ে বসেছেন সড়কের ওপর। এতে একদিকে যেমন যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে, তেমনি যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

বছরের শুরুতেই নষ্ট হলো সৌন্দর্য

উত্তর সিটি করপোরেশন প্রায় বছরখানেক আগে এই সড়ক মেরামত ও প্রশস্ত করেছিল। ফুটপাতে নতুন টাইলস বসানো হয় এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য গাইডলাইন স্থাপন করা হয়েছিল। তবে এখন এসব সব দোকানের আড়ালে চাপা পড়ে আছে। সড়কের মাঝখানে লাগানো গাছগুলোতেও পেরেক মেরে ত্রিপল টানিয়ে দোকানের ছাউনাস্বরূপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিদিন ময়লা-আবর্জনা, কাদা ও পলিথিনের কারণে একসময় দৃষ্টিনন্দন এই সড়কের কোনো সৌন্দর্য আর অবশিষ্ট নেই।

ক্ষোভে ফুঁসছে ভুক্তভোগীরা

গত বুধবার সাতক্ষীরা থেকে ছেলেকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে যাওয়ার জন্য ওই সড়কে যান রোকেয়া বেগম। তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের সাইনবোর্ড খুঁজছিলেন, কিন্তু বড় বড় দোকানের কারণে সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছিল না। পাশের একটি জুতার দোকানদারের কাছে গিয়ে তিনি হাসপাতালের দিক জানতে চান। ফুটপাতে বসা দোকানি হাসপাতালের পথ দেখিয়ে দেন। রোকেয়া বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসেছি, হাঁটার জায়গা নেই। রাস্তার ওপরই সব দোকান। হাসপাতালের সামনে এ রকম অবস্থা!’

চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সামনে দাঁড়িয়ে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা চোখে দেখতে পারেন না। কিন্তু হাসপাতালে ঢোকার আগেই রাস্তার পাশে ফল, চিপস, ফাস্টফুডের দোকানগুলো বসানো হয়েছে। ফুটপাতে হাঁটার কোনো জায়গা নেই, সব দোকান ফুটপাতে, তাই আমাদের সড়ক দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।’ চোখে চিকিৎসা করাতে আসা এক বৃদ্ধের ছেলে বলেন, ‘এক হাতে বাবাকে ধরে হাঁটছি, অন্য হাতে ছাতা সামলাতে পারছি না। রাস্তায় কোনো ফাঁকা জায়গা নেই, সব জায়গাতেই দোকান।’

দোকানিরা বলছেন, ‘টাকার বিনিময়ে সব হয়’

পঙ্গু হাসপাতালের পাশে ফুটপাতের ওপর একটি ভ্রাম্যমাণ ভাতের হোটেল চালাচ্ছেন মো. শামীম। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে বসি পরিবার চালানোর জন্য। প্রতিদিন টাকা দিতে হয়। আগে এক দল লোক আসত, এখন তারা এলাকা ছেড়ে গেছে। তাই এখন অন্য একটি দল আসে। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও সিটি করপোরেশনের সবাই ভাগ নেয়।’

এই এলাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে অবস্থিত, যা উত্তর সিটির অঞ্চল-৫ এর আওতায় পড়ে। সড়কে এই অবৈধ দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মো. ছাদেকুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সড়কের দুই পাশে ফুটপাতে অসংখ্য দোকান বসেছে। অবৈধ দখল আমাদের নজরে এসেছে। এই সড়কে আমরা দ্রুত বড় ধরনের অভিযান চালাবো। এর জন্য কিছু গাড়ি ও অন্যান্য উচ্ছেদ সামগ্রী সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!