‘স্যামসাংয়ের’ ভ্যাট ফাঁকি ১৬২ কোটি টাকা

সেবা সরবরাহকে দেখিয়েছে রপ্তানি

** বাংলাদেশে সেবা সরবরাহ করেছে স্যামসাং, কিন্তু ভ্যাট ফাঁকি দিতে সেই সেবাকে রপ্তানি হিসেবে দেখিয়েছে
** তিন অর্থবছর স্যামসাং প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার সেবা সরবরাহ করেছে, যার উপর ভ্যাট দেয়নি
** সেবাকে রপ্তানি দাবি করেছে স্যামসাং, তবে সিআইএস সেলে আমদানির কোন তথ্য পাওয়া যায়নি

বাংলাদেশে ‘সেবা সরবরাহ’ করা হয়েছে। কিন্তু সেই সেবাকে দেখানো হয়েছে ‘রপ্তানি’ হিসেবে। তিন অর্থবছর সেবা সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় ৪৬০ কোটি টাকা। যার উপর ভ্যাট দেয়নি সুদসহ প্রায় ১৬২ কোটি টাকা। বহুজাতিক কোম্পানি স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভট লিমিটেডের বিরুদ্ধে এই বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। শুনানি শেষ হয়েছে। সহসাই চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হবে। স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকির প্রতিবেদনের একটি কপি ‘বিজনেস বার্তার’ হাতে রয়েছে।

অর্থাৎ স্যামসাংকে এই বিপুল পরিমাণ ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। স্যামসাং এর মতো বহুজাতিক কোম্পানির এমন নব কৌশলে ভ্যাট ফাঁকিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা। আর ভ্যাট অফিস বলছে, স্যামসাং ইন্ডিয়া বাংলাদেশে তাদের পণ্য বিক্রি ও বিক্রয়োত্তর বিভিন্ন সেবা প্রদান করে। সেই সেবাকে তারা সরবরাহ না দেখিয়ে রপ্তানি দেখায়। তারা বলছে অনিবাসী হিসেবে তারা সেবা রপ্তানি করে। আবার বলে রপ্তানির বিপরীতে দেশে রেমিট্যান্স আসে। অথচ, ভ্যাট আইনে দেশের মধ্যে সেবা সরবরাহ করলে তার উপর ভ্যাট দিতে হয়। ভ্যাট ফাঁকি দিতে তাদের এটা কৌশল।

Samsung India 1
এনবিআর সূত্রমতে, স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেড বাংলাদেশে সরাসরি পণ্য বিক্রি করে না। কয়েকটি ডিলার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্যামসাংয়ের তৈরি পণ্য বিক্রি করে আসছে। তবে বাংলাদেশে স্যামসাং ইন্ডিয়ার শাখা অফিস রয়েছে। স্যামসাং ইন্ডিয়া সেবা সরবরাহকে সেবা রপ্তানি দেখিয়ে ভ্যাট পরিশোধ করছে না বলে অভিযোগ উঠে। এরই প্রেক্ষিতে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেট প্রতিষ্ঠানটি নিরীক্ষা করে। প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কাগজপত্র, ভ্যাট রিটার্ন (দাখিলপত্র) ও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন (সিএ রিপোর্ট) যাচাই করা হয়। বিশেষ করে ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত (২০১৬-১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর) কাগজপত্র যাচাই করা হয়। এতে এই তিন অর্থবছর সেবা রপ্তানি দেখিয়ে ভ্যাট পরিহার বা ফাঁকির তথ্য পায় নিরীক্ষার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা। পরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্যামসাং ইন্ডিয়া ২০১৬-১৭ হতে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৪৬০ কোটি ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ১৫৭ টাকার সেবা প্রদান করেছে। যার মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ২৫ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৭ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ১৬১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৭৮৯ টাকা ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২৭২ কোটি ৫১ লাখ ৪৯ হাজার ৪০১ টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটি এই তিন অর্থবছর অর্থাৎ ৩৬ কর মেয়াদে দাখিলপত্র বা ভ্যাট রিটার্নে এই বিপুল পরিমাণ সরবরাহ করা সেবা বা সেবা প্রদানকে রপ্তানি হিসেবে দেখিয়েছে। অথচ মূসক আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি যে সেবা প্রদান করেছে, তা মূসক বা ভ্যাট আরোপযোগ্য মূল্য হিসেবে বিবেচ্য হবে। যার উপর প্রযোজ্য মূসক ১৫ শতাংশ। সে হিসেবে সেবা সরবরাহের উপর ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট ৬৯ কোটি ২ লাখ ৯০ হাজার ৭২৪ টাকা। যার উপর ২ শতাংশ হারে প্রযোজ্য সুদ ৯৩ কোটি ২৮ লাখ ৭৭ হাজার ১৬৭ টাকা।

Samsung India 2
প্রতিবেদনে বলছে, স্যামসাং ইন্ডিয়া এর সাথে চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশ শাখা অফিসে ভোক্তা ইলেকট্রনিক্স পণ্য, আনুষাঙ্গিক, আইটি হার্ডওয়্যার, ফোন সেটের বিপণন ও বিক্রয়, বিক্রয়োত্তর সেবা, ওয়ারেন্টি দাবি, প্রতিস্থাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। শাখা অফিস পণ্যের মার্কেটিং সার্ভিসের আওতায় পণ্যের প্রচারণামূলক কার্যক্রম, পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধিতে প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক প্রস্তাব, পণ্যের বিক্রয় কৌশল বাস্তবায়ন, পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি, পণ্যের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি, সম্ভাব্য গ্রাহকদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি ও বজায় রাখা ইত্যাদি কাজ করে থাকে। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এর ধারা-৬ এর উপধারা ৩(ঘ) অনুযায়ী, কোন নিবন্ধিত বা নিবন্ধনযোগ্য ব্যক্তি কর্তৃক ব্যবসা পরিচালনা বা সম্প্রসারণকালে প্রদত্ত সেবার উপর মূসক প্রদেয় হবে, নিম্নবর্ণিত কার্যাবলির মধ্যে যা সর্বাগ্রে ঘটে। যা সংঘটিত হওয়ার সময়ে ‘বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানার বাইরে হতে বাংলাদেশে সেবা সরবরাহ গ্রহণ করা হলে যখন আংশিক বা পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়’। এক্ষেত্রে স্যামসাং ইন্ডিয়া (ভারত) বাংলাদেশের বাইরে হতে স্যামসাং ইন্ডিয়ার (বাংলাদেশ) মাধ্যমে বাংলাদেশি গ্রাহক বা সেবা গ্রহীতাদের সেবা প্রদান করে থাকে। ফলে সরবরাহ বাংলাদেশে প্রদান করা হয়েছে বিধায় মূসক প্রযোজ্য ও আদায়যোগ্য হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি সেবা রপ্তানি দাবি করলেও প্রতিষ্ঠানটির বিপরীতে কোন বৈদেশিক মুদ্রা প্রত্যাবাসিত হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিআইএস সেল হতে যাচাই করে প্রতিষ্ঠানটির নামে কোনো আমদানির তথ্য পাওয়া যায়নি। স্যামসাং ইন্ডিয়ার মতো সমজাতীয় ‘বায়োনার করপোরেশন, কোরিয়া এবং এস বি সল্যুয়েশন, বাংলাদেশ’-এর একই সমস্যা হয়েছে। পরে এনবিআরকে তারা চিঠি দেয়। এনবিআর ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে। যাতে সেবা সরবরাহকে সেবা রপ্তানি হয়েছে বলে দাবি করার সুযোগ নেই বলে বলা হয়েছে। এনবিআরের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ডেস্টিনেশন প্রিন্সিপাল অনুসারে স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেডের দেওয়া সেবা বাংলাদেশে প্রদান করা হয়েছে। ফলে এই সেবা রপ্তানি বা শূন্য হার হিসেবে গণ্য করার কোন আইনগত সুযোগ নেই। যার জন্য সেবা সরবরাহের উপর স্যামসাংকে ফাঁকি দেওয়া এই ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে।

অপরদিকে, সেবা সরবরাহ ছাড়াও নিরীক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন সেবা কেনাকাটা বা ব্যয়ের উপর উৎসে কর ফাঁকি উদ্ঘাটিত হয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি মোট ৩৫ কোটি ৫৭ লাখ ৫ হাজার ৬৩৯ টাকা সেবা ক্রয় বা কেনাকাটা করেছে। যার উপর সুদসহ ৫৭ লাখ ৪৬ হাজার ৪৫ টাকা উৎসে মূসক পরিশোধ করা হয়নি। সেবা সরবরাহ ও কেনাকাটা বা ব্যয়ের উপর সুদসহ মোট ১৬২ কোটি ৮৯ লাখ ১৩ হাজার ৯৫৭ টাকা ভ্যাট পরিশোধে ঢাকা ভ্যাট উত্তর কমিশনারেট থেকে চলতি বছরের মার্চ মাসে স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেডকে মূসক আইন, ১৯৯১ এর ৫৫ এর উপধারা (১) অনুযায়ী দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে।

এই বিষয়ে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা <strong>বিজনেস বার্তাকে বলেন, স্যামসাং বলছে তারা অনিবাসী ব্যক্তি। বাংলাদেশে ব্যবসা করলেও তারা স্যামসাং ইন্ডিয়ার পক্ষে কাজ করছে। বাংলাদেশে সেলস প্রমোশনলের জন্য তারা স্যামসাং ইন্ডিয়ার হয়ে অ্যাডভারটাইসমেন্ট করছে। তবে ভ্যাট আইনে বলা আছে, বাংলাদেশে যদি কোন সেবা দেয় বা কোন পণ্যের উপর কায়িকভাবে কিছু দেয়া হয়-তা সেবা রপ্তানি হবে না। এটা নীতির একটা বিষয়। তবে আইনে এই বিষয়ে আরেকটু স্পষ্টীকরণের দরকার আছে। স্যামসাং কর্তৃপক্ষ বলছে, বাংলাদেশের শাখা অফিস চালানো বা খরচের জন্য স্যামসাং ইন্ডিয়া যে রেমিট্যান্স পাঠায়, সেটাকে তারা আবার প্রদেয়, এটা আবার রপ্তানি। এই টাকার সমপরিমাণ সেবা আমি রপ্তানি করেছি। একদিকে তারা রেমিট্যান্স বলছে, আরেকদিকে রপ্তানি বলছে। তবে আমরা বলছি, সেবা যদি দেশে দিয়ে থাকে, তা রপ্তানি হবে না। সেজন্য এই সেবার উপর ভ্যাট দিতে হবে। শুনানি শেষ হয়েছে, সহসাই ভ্যাট অফিস চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করে দেবে। এই দুই অর্থবছর ছাড়াও অন্যান্য অর্থবছর আমরা ফাঁকি উদ্ঘাটনে নিরীক্ষা করবো।

এই বিষয়ে স্যামসাং ইন্ডিয়া ইলেকট্রনিক্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে বিজনেস বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে লিখিত প্রশ্ন দিতে বলা হয়। পরে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পিআর এর মাধ্যমে স্যামসাং এর মুখপাত্র জানান, ‘দায়িত্বশীল করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্যামসাং প্রযোজ্য সকল আইন ও বিধি মেনে চলে। যেহেতু, বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়াধীন-এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!