বিশ্বের অনেক দেশই কর ব্যবস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রমকে আলাদা করেছে। বাংলাদেশে এই উদ্যোগ প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, তবে পরে তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারও রাজস্ব কার্যক্রম সংস্কারের অংশ হিসেবে কর নীতি ও কর সংগ্রহ আলাদা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, সম্প্রতি রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠনের প্রস্তাবসহ একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে সরকার।
বিশ্বের অনেক দেশই কর ব্যবস্থার দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রমকে আলাদা করেছে। বাংলাদেশে এই উদ্যোগ প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়, তবে পরে তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারও রাজস্ব কার্যক্রম সংস্কারের অংশ হিসেবে কর নীতি ও কর সংগ্রহ আলাদা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের মতো বহুজাতিক দাতা সংস্থাগুলি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, সম্প্রতি রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠনের প্রস্তাবসহ একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যাচ্ছে না। তাদের ভাষায়, মূলত প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও করজালের বাইরে থাকা দেশের অধিকাংশ অর্থনৈতিক ইউনিটের কারণে এই সমস্যা। বর্তমানে, দেশের অনেক বড় অর্থনৈতিক ইউনিট এখনও সরকারের করজালের বাইরে রয়েছে, এবং অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি ক্রমাগত বাড়ছে। এর ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিম্ন কর-জিডিপি আহরণকারী দেশে পরিণত হয়েছে। যদিও ব্যক্তি পর্যায়ে আয়কর ছাড়াও সেলফোনে কথা বলা, কেনাকাটা, হোটেলে খাওয়া, সিনেমা দেখা ইত্যাদি দৈনন্দিন লেনদেনে কর রয়েছে, তবে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে দেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি অর্থনৈতিক ইউনিট এখনও করজালের বাইরে রয়েছে। কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও পাকিস্তানের মতো দেশও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। বর্তমানে, এই অনুপাত ৭-৮ শতাংশের ওপরে উঠানো সম্ভব হচ্ছে না, এবং জিডিপির অতিরঞ্জিত তথ্য এই পরিস্থিতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করলেই যে রাজস্ব আহরণ বাড়বে, এমন নয়। দুটি বিভাগ করা হলে দুজন সচিব হবেন। এতে লোকবল বাড়বে, যারা কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন, তারা লাভবান হবেন। কিন্তু এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। যেসব সমস্যা ও দুর্বলতার কারণে রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না সেগুলোর সমাধান করতে হবে। আমাদের গোটা সিস্টেমে দুর্নীতি মাথা গেড়ে আছে। এটি দূর করা না হলে এবং অটোমেশন করা না হলে রাজস্ব আহরণ বাড়বে না। শুধু এনবিআরকে আলাদা করে দুটি বিভাগ করে দিলেই রাজস্ব আহরণ বাড়বে বিষয়টিকে এত সহজ হিসেবে বিবেচনা করলে সেটি ফলপ্রসূ হবে না। রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করার প্রয়োজন আছে তবে এটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। এর সঙ্গে অন্য ব্যবস্থাগুলোও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না।’
এছাড়া প্রত্যক্ষ কর আহরণেও এনবিআরের অনীহা রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানো জরুরি বলে অভিমত তাদের। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) ছিলেন। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৪৩ লাখ। টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বাড়েনি। নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়লেও রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা সেই তুলনায় কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমসংখ্যক রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত করদাতা জরিপের অনুপস্থিতি এবং কর প্রশাসনের অটোমেশনের ধীরগতিই দায়ী। এছাড়া রিটার্ন দাখিলের প্রমাণও (পিএসআর) যথাযথভাবে তদারকি হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে দেশে কর আহরণ ব্যবস্থা যথাযথভাবে সম্প্রসারিত হয়নি। ফলে কর পরিশোধে মানুষের আগ্রহ কম।
সরকারের সাবেক সচিব ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এক সময় এনবিআরের কর নীতির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বিদ্যমান ব্যবস্থায় শুধু স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হলেই রাজস্ব আহরণ বাড়বে না বলে মনে করছেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুধু নীতি প্রণয়নের জন্য আলাদাভাবে একটা বিভাগ করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এতে মাথাভারী প্রশাসন হয়ে যেতে পারে। ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা বিভাগ থাকতে পারে। তবে এক্ষেত্রে দু্ই বিভাগের সচিবের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে সেটি একটি প্রশ্ন। এক সচিব তো আরেক সচিবের অধীনে থাকতে পারেন না। নীতি যে বাস্তবায়ন করবে, তার সঙ্গে আলোচনা না করে তো নীতি প্রণয়ন সম্ভব নয়। আবার নীতি কীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে, সেজন্যও নির্দেশনার প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে দুই বিভাগেরই একে অন্যের ওপর নির্ভরতা থাকবে। ফলে দুই বিভাগের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেট প্রণয়নের সময় তো আরো বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীই এ দুই বিভাগের সচিবকে তদারকি করবেন। একমাত্র সাইফুর রহমান ছাড়া আমি এ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রীকে দেখিনি, যিনি এ ধরনের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা করার মতো অভিজ্ঞ।’
কয়েক বছর ধরেই দেশে জিডিপির অনুপাতে কর আহরণের হার কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব আহরণ করে এনবিআর। সে সময় কর-জিডিপির হার ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। সেবার বাড়লেও পরে তা কমতে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬০১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা আহরণ করে সংস্থাটি। কর-জিডিপির হার ছিল ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর পর কর-জিডিপির অনুপাত কখনই সাড়ে ৭ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থছরেও কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। রাজস্ব আহরণ হয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের ৯ অক্টোবর রাজস্ব নীতি সংস্কারবিষয়ক একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান করা হয় এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদকে। এছাড়া এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ, সাবেক সদস্য মো. দেলোয়ার হোসেন, ফরিদ উদ্দীন ও আমিনুর রহমানকে সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কমিটি গত বছরের ২২ ডিসেম্বর সরকারের কাছে একটি অন্তর্বর্তী সুপারিশ জমা দেয়। এর ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গতিশীলতা বাড়াতে বিদ্যমান কাঠামো পুনর্গঠন করে রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে সরকার।
এ উদ্দেশ্যে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (পৃথক্করণ) অধ্যাদেশ ২০২৫ শীর্ষক খসড়ায় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অধীনে দুটি বিভাগ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের ন্যূনতম ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্যে পালাক্রমে এ দুই বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিয়োগ করা হবে। এ দুই বিভাগের অধীনে থাকা বিভিন্ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং সহকারী সচিব পদসহ সমপদমর্যাদার পদগুলোও বিসিএস কাস্টমস ও বিসিএস কর ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূর্ণ করা হবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি বিভাগে এ দুই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন একটি কমিটির মাধ্যমে করা হবে। এ কমিটির প্রধান থাকবেন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা এবং সদস্য হিসেবে থাকবেন অর্থ বিভাগ, রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের পদায়ন এ বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার মাধ্যমে করা হবে। কাস্টমস, এক্সাইজ এবং মূল্য সংযোজন কর আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং কর আপিল ট্রাইব্যুনাল রাজস্ব নীতি বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত দপ্তর হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে আয়কর আপিল এবং কাস্টমস ও মূল্য সংযোজন করসংক্রান্ত আপিল অফিসগুলো রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরের বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত করা হবে। পাশাপাশি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব নীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। দুই বিভাগই নিজ নিজ কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন, আদেশ, ব্যাখ্যাপত্র জারি করতে পারবে।
রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস-শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ এবং অন্যান্য শুল্ক-করাদি সংশ্লিষ্ট আইন প্রণয়ন, সংশোধন ও এর ব্যাখ্যা প্রদান, রাজস্ব নীতি সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান, প্রজ্ঞাপন, এসআরও প্রণয়ন, সংশোধন ও এর ব্যাখ্যা প্রদান। আয়কর, ভ্রমণ কর, দান কর, সম্পদ কর, কাস্টমস-শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, সারচার্জ এবং অন্যান্য শুল্ক-করাদি, ফি আরোপ ও অব্যাহতি প্রদানসংক্রান্ত কার্যক্রমও এ বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এছাড়া রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী অন্যান্য কার্যক্রম এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অন্য যেকোনো দায়িত্বও এ বিভাগ পালন করবে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যপরিধির বিষয়ে অধ্যাদেশের খসড়ায় বলা হয়েছে, রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব এ বিভাগের অধীনে থাকবে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমসসংক্রান্ত চুক্তি আলোচনা, সম্পাদন ও মতামত প্রদান, আন্তর্জাতিক দ্বৈত কর পরিহার চুক্তিসংক্রান্ত কার্যক্রমও পরিচালনা করবে এ বিভাগ। বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও এর অধীন দপ্তরগুলোর ক্যাডার-বহির্ভূত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের বাজেট প্রণয়ন, বাজেট বাস্তবায়ন এবং লজিস্টিকস-সংক্রান্ত কার্যক্রম, রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত পদ্ধতিগত বিধিমালা প্রণয়ন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কার্যক্রমের দক্ষতা, কার্যকারিতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন, অধীনস্থ অফিসগুলোর তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনাসহ রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী অন্যান্য কার্যক্রম এবং সরকার অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্বও পালন করবে এ বিভাগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম এবং রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৃথক্করণের মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এমন একটি কর কাঠামো প্রণয়ন করা, যাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মাধ্যমে বিপুল কর্মক্ষম জনগণের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়। বাংলাদেশে আয়কর, মূসক এবং কাস্টমসসংক্রান্ত আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান এমন হতে হবে, যাতে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর কর কাঠামোর তুলনায় আমাদের কর কাঠামো বেশি আকর্ষণীয় হয়। দেশী-বিদেশী ব্যবসা বাণিজ্যবান্ধব কর কাঠামো প্রণয়নের জন্য যে ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ এবং গবেষণার প্রয়োজন এবং এ কাজগুলোর জন্য যে ধরনের জনবল কাঠামো প্রয়োজন, বিদ্যমান ব্যবস্থায় তার সংস্থান নেই। রাজস্ব নীতি বিভাগ স্বতন্ত্র একটি বিভাগের অধীন হলে সারা বছর বিভিন্ন খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের পর্যাপ্ত বিচার-বিশ্লেষণ এবং গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ প্রণীত আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কর আহরণ তথা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যক্রম আলাদা একটি বিভাগের অধীন থাকলে কর কর্মকর্তারা সব করদাতার কাছ থেকে আইনানুগ কর আহরণে একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করতে পারবেন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ কেবল কর আদায় কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকবে বিধায় কর কর্মকর্তারা করজাল বিস্তারে এবং এর অন্তর্ভুক্ত সব করদাতাকে কর আইনের যথাযথ পরিপালনের জন্য নিবিড় তদারকি ও পরিচর্যা করতে সক্ষম হবে। এর ফলে রাজস্ব ফাঁকি কমবে, কর পরিপালন সংস্কৃতির প্রভূত উন্নতি হবে এবং সার্বিকভাবে কর আহরণের পরিমাণ বহুলাংশে বাড়বে।’
রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ নিয়ে বিসিএস প্রশাসন এবং বিবিএস (শুল্ক ও আবগারি) ও বিসিএস (কর) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও কাজ করছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মনে করছেন, রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব হিসেবে এনবিআরের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হলে সেক্ষেত্রে নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথক করার কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। কারণ তখন আলাদা দুটি বিভাগ থাকলেও সেটি কার্যত এনবিআরেরই কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। তাছাড়া রাজস্ব নীতি সংস্কারে যে কমিটি করা হয়েছে তাদের সবাই ছিলেন ট্যাক্স ও কাস্টমস ক্যাডারের। তাদের সুপারিশগুলো পুরোপুরি নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে দেয়া হয়েছে কিনা, সে বিষয়েও প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রশ্ন উঠছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘কর নীতি ও কর সংগ্রহ কার্যক্রম আলাদা করার ফলে রাজস্ব আহরণ কতটা বাড়বে, এ বিষয়ে আমরা কোনো নির্দিষ্ট মডেলিং করিনি। তাই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে এতে রাজস্ব আহরণ কতটা বৃদ্ধি পাবে। তবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এর ফলে বিচ্যুতি কমে যাবে, সমঝোতামূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে না, অটোমেশন বৃদ্ধি পাবে এবং এনবিআর কর সংগ্রহের দিকে আরও মনোযোগী হবে। অন্যদিকে, রাজস্ব নীতি প্রণয়নের দায়িত্বে যারা থাকবেন, তাদের পরামর্শে নীতি প্রণয়ন করা হবে। শুধু এক বা দুইটি বিষয় নয়, সব বিষয় একসঙ্গে কাজ করলে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি সম্ভব হবে। তবে দেশের অর্থনীতি যদি সমৃদ্ধ না হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি না পায়, তাহলে কর কোথা থেকে আহরণ হবে? তবুও এটি একটি ভালো পদক্ষেপ।’
**এনবিআর ভেঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে দুই বিভাগ হচ্ছে
**রাজস্ব কমিশন নয়, বিভাগ হবে