স্টারলিংকের সঙ্গে অংশীদার হতে চায় বিএসসিএল

স্টারলিংকসহ অন্যান্য স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবাদাতাদের বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এর গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ রুট করতে বাধ্য করতে, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অনুরোধ জানিয়েছে বিএসসিএল। বিএসএলের এ উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই স্যাটেলাইট কোম্পানির সম্পদের ব্যবহার ও আয় বাড়ানো।

তবে নন-জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট অরবিট (এনজিএসও) পরিচালকদের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) এটি বাধ্যতামূলক করার সম্ভাবনা কম। কারণ এ উদ্যোগ স্টারলিংকের মতো আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে পারে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এক চিঠিতে ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেইসঙ্গে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে স্টারলিংক চালু করার প্রস্তাব দেন।

বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চলতি সপ্তাহেই এনজিএসও স্যাটেলাইট সেবা পরিচালনার চূড়ান্ত নীতিমালা ও লাইসেন্সিং গাইডলাইন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে জমা দেওয়া হবে। তবে এনজিএসও যাত্রায় বিএসসিএলকে অংশীদার করার সরকারের ইচ্ছা সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য কল ও এসএমএস করা হলেও তাতে সাড়া দেননি বারী।

বিটিআরসির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিদ্যমান টেলিযোগাযোগ আইনে শতভাগ বিদেশি মালিকানার অনুমতি রয়েছে। ফলে কোনো বিদেশি এনজিএসও অপারেটর কোম্পানির ওপর স্থানীয় মালিকানা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া বিটিআরসির অভ্যন্তরীণ আলোচনার উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আরও বলেন, কোনো এনজিএসও অপারেটরকে নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসায়িক অংশীদার গ্রহণে বাধ্য করাও টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পক্ষে যুক্তিযুক্ত হবে না।

বিএসসিএলের জেনারেল ম্যানেজার ও হেড অভ সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং শাহ আহমেদুল কবির বলেন, প্রকাশিত খসড়া নীতিমালা অনুসারে, এনজিএসও অপারেটরদের অবশ্যই স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) থেকে ব্যান্ডউইডথ কিনতে হবে। পাশাপাশি দেশের টেলিকম আইন মেনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত গেটওয়ে স্টেশনের মাধ্যমে তাদের স্যাটেলাইটে ইন্টারনেট রুট করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এই স্যাটেলাইটগুলো তখন সরাসরি গ্রাহকের ডিভাইসে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করবে, দূরত্ব-সংক্রান্ত বাধা দূর করবে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সহজলভ্য হবে।

ভারতের ইসরো-র মতোই ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রস্তাব করেছে, এনজিএসও লাইসেন্সধারীদের জন্য বিএসসিএলকে একটি গেটওয়ে করার সুযোগ রাখা যেতে পারে, যা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির জন্য কিছু ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি এনজিএসও ইন্টারনেটকে আরও দৃশ্যমান করবে।

তবে টেলিকম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিএসসিএলের বর্তমান গ্রাউন্ড স্টেশন মূলত জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের জন্য তৈরি, যা পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকে। অন্যদিকে এনজিএসও স্যাটেলাইটগুলো মাত্র ৫০০ থেকে ২ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় কাজ করে। ফলে এসব স্যাটেলাইটের সংযোগের জন্য আলাদা অ্যান্টেনা ও ফ্রিকোয়েন্সি প্রয়োজন হবে।

বিএসসিএল ইতিমধ্যেই পাঁচটি রিসিভারের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের জন্য স্টারলিংক ইন্টারনেটের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।বিটিআরসি ২০২৪ সালের শুরু থেকেই এনজিএসও স্যাটেলাইটের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ শুরু করে, যার মূল লক্ষ্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ সম্প্রসারণ। তবে শহরাঞ্চলের জন্য এই ইন্টারনেটের এত প্রয়োজন নেই।

খসড়া নীতিমালায় এনজিএসও অপারেটরদের জন্য স্থানীয় আইআইজি রাউটিং ও গ্রাউন্ড স্টেশন ব্যবহার বাধ্যকতামূলক করায় নিরবচ্ছিন্ন ও নজরদারি-মুক্ত ইন্টারনেটের স্বপ্ন দেখছিলেন এমন অনেকে হতাশ হয়েছেন।

বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, বেশিরভাগ দেশ জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এটি করেছে বলে এ নিয়ম বহাল থাকবে।বাংলাদেশে প্রথম প্রবেশ করা স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা দেওয়া প্রথম কোম্পানি হতে পারে স্টারলিংক। অবশ্য বিটিআরস্যার সঙ্গে আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির আলোচনায় চলছে।

স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ক্রমেই বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ধরনের এই ইন্টারনেট সংযোগের জনপ্রিয়তা মূলত এর খরচের ওপর নির্ভর করবে। স্টারলিংকের জন্য একজন ব্যবহারকারীকে ৫০০-৭০০ ডলার মূল্যের যন্ত্রপাতি কিনতে হতে পারে। আর প্রতি মাসে ১০০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেটের জন্য প্রায় ১২০ ডলার খরচ হবে। কম গতির সংযোগের ক্ষেত্রে মাসিক খরচ হবে।

যেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও ফাইবার অপটিক ক্যাবল বা মোবাইল ইন্টারনেট শক্তিশালী হয়নি, সেখানে স্টারলিংকের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতারা (আইএসপি) এই সংযোগ ব্যবহার করে লাভজনকভাবে একাধিক গ্রাহকের কাছে ইন্টারনেট বিক্রি করতে পারবে।আফ্রিকার কিছু দেশের মতো যদি বাংলাদেশেও স্টারলিংক সরঞ্জাম ভাড়ার সুবিধা চালু হয়, তাহলে গ্রামাঞ্চলের আইএসপিরা এতে বেশি আগ্রহী হতে পারে। একইসঙ্গে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ব্যাকআপ সংযোগের জন্য এনজিএসও ইন্টারনেট গ্রহণ করবে।

টেলিকম পলিসি বিশ্লেষক মোস্তাফা মাহমুদ হোসেন বলেন, যদি সাশ্রয়ী মূল্যে ও ব্যবহারবান্ধব উপায়ে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে স্টারলিংক গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ‘রিমোট শিক্ষা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসেবা, গ্রামীণ ডিজিটাল অর্থনীতি, নারীর ক্ষমতায়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সংযোগ—সবকিছুরই এ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত, বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে,’ বলেন তিনি।স্থানীয় ইন্টারনেট সেবাদাতারা স্যাটেলাইট ও নন-স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের জন্য সমান কর ও শুল্কসহ সমান সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!