- দুই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠান ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ টাকার পণ্য ক্রয় গোপন করা হয়েছে
- সেবার উপর সঠিকভাবে উৎসে কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠান
পণ্য ক্রয় করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকের বার্ষিক বিবৃতিতে দেখানো হয়েছে। কিন্তু মূসক দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) তা দেখানো হয়নি। মূলত মূসক (উৎসে মূসক) ফাঁকি দিতেই প্রতিষ্ঠান প্রকৃত ক্রয় গোপন করেছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রেও সঠিকভাবে উৎসে মূসক কর্তন করা হয়নি। মূসক ফাঁকি দেয়া প্রতিষ্ঠান হলো প্রযুক্তি পণ্য ও সেবা বিক্রয়কারী স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানের দুই অর্থবছরে প্রায় ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকার বেশি মূসক ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেট। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের দাবি, ভ্যাট বিভাগের দাবি করা ভ্যাট তাদের লাভ থেকে সমন্বয় করা হয়েছে।
এনবিআর সূত্রমতে, স্টারটেক ঢাকাসহ সারাদেশে প্রযুক্তি পণ্য ও সেবা বিক্রির শো-রুম রয়েছে। এসব শো-রুমে প্রযুক্তি পণ্য বিশেষ করে কম্পিউটার ও কম্পিউটার এক্সেসরিজ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, ইউপিএস, ক্যামেরা, সিকিউরিটি ক্যামেরা, সফটওয়্যার, টেলিভিশন, এসি ইত্যাদি খুচরা ও পাইকারী বিক্রি করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিশেষ করে স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ উঠে। এই প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয় ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেটের আওতাধীন ভ্যাট মিরপুর বিভাগ। প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূসক সংক্রান্ত কাগজপত্র ও বার্ষিক বিবরণী (সিএ রিপোর্ট) সংগ্রহ করা হয়। এসব কাগজপত্রের তথ্যের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের প্রতিমাসে জমা দেয়া মূসক দাখিলপত্রে (ভ্যাট রিটার্ন) উল্লেখিত তথ্য যাচাই করা হয়। এছাড়া স্টারটেক একটি লিমিটেড প্রতিষ্ঠান। মূসক আইন অনুযায়ী, লিমিটেড প্রতিষ্ঠান উৎসে কর্তনকারী সত্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সেবা ও পণ্য ক্রয়ের উপর উৎসে মূসক কর্তন করে রাষ্টীয় কোষাগারে জমা দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি সঠিকভাবে উৎসে কর কর্তন করে জমা দেয়নি। এছাড়া পণ্য ক্রয় কম দেখিয়েও উৎসে মূসক ফাঁকি দিয়েছে বলে যাচাইয়ে উঠে এসেছে।
প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিবরণী (সিএ রিপোর্ট) যাচাই করে ভ্যাট বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর বিভিন্ন সেবা ক্রয়ের বিপরীতে সঠিকভাবে উৎসে মূসক কর্তন করেনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি এন্টারটেইনমেন্ট, অফিস ভাড়া, ইন্টারনেট বিল, সফটওয়্যারে ব্যয়, পরিবহন খরচ, অফিস খরচ, পরিবহন রিপেয়ার এন্ড মেন্টেনেন্স, প্রিন্টিং ও স্টেশনারী, পোস্টাল ও কুরিয়ার সার্ভিস, ফটোকপি, অডিট ফি, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, অফিস ডেকোরেশন, অফিস ফার্নিচার, অফিস সরঞ্জামিসহ বিভিন্ন সেবার উপর প্রযোজ্য উৎসে মূসক ৫৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯২ টাকা। যার মধ্যে ২৫ লাখ ৩১ হাজার ১৮২ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। একইভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছর প্রযোজ্য উৎসে মূসক ৪১ লাখ ৯২ হাজার ৮৩০ টাকার মধ্যে ৩২ লাখ ৩ হাজার ৩২৭ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। অর্থাৎ এই দুই অর্থবছর মোট ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫০৯ টাকার উৎসে মূসক পরিশোধ না করা প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের এই দুই অর্থবছরের ক্রয় ও বিক্রয় হিসাব পর্যালোচনা করা হয়েছে। অথাৎ প্রতিষ্ঠানের প্রতিমাসে জমা দেয়া দাখিলপত্র ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবৃতি যাচাই করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান ২০২১-২২ অর্থবছর রিটার্ন অনুযায়ী পণ্য ক্রয় দেখানো হয়েছে ১৩৫ কোটি ৯ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৯ টাকা। কিন্তু ওই অর্থবছর ব্যাংক হতে প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আর্থিক বিবৃতিতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠান ওই অর্থবছর মোট পণ্য ক্রয় করেছে ১৮২ কোটি ২৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬০৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ২০২০-২১ অর্থবছর ৪৭ কোটি ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৬৭ টাকা মূল্যের সমান অপ্রদর্শিত পণ্য ক্রয় করেছে, যার মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ৪৩ কোটি ৮৫ লাখ ৩৩ হাজার ৮৬ টাকা। উৎসে মূসক বিধিমালা অনুযায়ী, লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে পণ্য ক্রয়ের উপর উৎসে মূসক কর্তনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে অনুযায়ী অপ্রদর্শিত পণ্য ক্রয়ের উপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রযোজ্য উৎসে মূসক ৩ কোটি ২৮ লাখ ৮৯ হাজার ৯৮১ টাকা।
একইভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছর প্রতিষ্ঠান মূসক দাখিলপত্রে পণ্য ক্রয় দেখিয়ে ১৭৭ কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৫ টাকা। কিন্তু ব্যাংক হতে প্রাপ্ত বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান ওই অর্থবছর ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮৪ টাকা মূল্যের সমান অপ্রদর্শিত ক্রয় করেছে, যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ৪৪ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৬ টাকা। যার উপর সাড়ে ৭ শতাংশ হারে প্রযোজ্য উৎসে মূসক ৩ কোটি ৩২ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৮ টাকা। এই দুই অর্থবছরে প্রতিষ্ঠান ৯৪ কোটি ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ টাকার পণ্য ক্রয় গোপন করেছে। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য মূল্য ৮৮ কোটি ১৪ লাখ ৪৯ হাজার ৭২২ টাকা। যার উপর মোট ৬ কোটি ৬১ লাখ ৮ হাজার ৭২৯ টাকার মূসক (সুদ ব্যতীত) ফাঁকি দেয়া হয়েছে। আর সেবা ক্রয়ের বিপরীতে ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৫৭ লাখ ৩৪ হাজার ৫০৯ টাকা। দুই অর্থবছর মোট উৎসে মূসক ফাঁকি দেয়া হয়েছে ৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৮ টাকা (সুদ ব্যতীত)।
সূত্রমতে, ফাঁকি দেয়া মূসক পরিশোধে ভ্যাট ঢাকা পশ্চিম কমিশনারেট থেকে প্রতিষ্ঠানকে ৩ জুন দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। ২৩ জুন প্রতিষ্ঠানকে শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জবাব দিয়েছে।
এই বিষয়ে স্টারটেক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কাছে বক্তব্য চাওয়া হয়। পরে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. রাশেদ আলী ভূঁইয়া লিখিত বক্তব্যে জানান, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভ্যাট নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করে কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা পশ্চিমের মিরপুর বিভাগীয় দপ্তর হতে ৩ মে আমাদের বরাবর কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দুই বছরের ভ্যাট ফাঁকি হিসাব করা হয়েছে সর্বমোট ৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৮ টাকা, যা বিভিন্ন খরচ খাতে বিশেষ করে লোকাল ক্রয় এর বিপরীতে লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় উৎসে কর্তনকারী সংস্থা হিসেবে কম কর্তন করা হয়েছে বলে আমাদেরকে নোটিশে জানানো হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৩ হাজার ২৩৮ টাকা সমন্বয় করেছি। কিন্তু উক্ত ভ্যাট পরিশোধ আমাদের জন্য কষ্টসাধ্য এবং আমাদের লাভ হতে সমন্বয় করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, বর্তমানে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় সাত হাজার ব্যবসায় রয়েছে। এর মধ্যে নিবন্ধিত লিমিটেড কোম্পানি খুব কম রয়েছে। লিমিটেড কোম্পানি হওয়ায় নিবন্ধিত উৎসে কর্তনকারী সত্তা হিসেবে উৎসে ভ্যাট কর্তন শুধুমাত্র লিমিটেড কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য। অন্যান্য ব্যক্তি মালিকানার জন্য ইহা প্রযোজ্য নয়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আইটি খাতে ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ এবং ট্যাক্সে ৫ শতাংশ উৎসে কর্তনের বিধান রয়েছে। অর্থাৎ সর্বমোট সাড়ে ১২ শতাংশ অতিরিক্ত মূল্য লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আমাদের প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে ব্যবসা প্রসারের জন্য ব্যাংকিং সুবিধা এবং আমদানি বৃদ্ধির জন্য লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত থাকাও জরুরি। এই আইটি খাতটি সম্মৃদ্ধ করতে হলে এ সকল সমস্যার সমাধান প্রয়োজন।
****