ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বছরে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে। এক বছরের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের নামে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ৩৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ কোটি ৯৫ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে। গোপনীয়তার নীতির কারণে সুপরিচিত এই দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট পাওনা এই পরিমাণ। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ফ্রাঙ্ক ১৫০ টাকা ধরে) এর টাকার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৩৫ কোটি ৫২ লাখ টাকারও বেশি। ২০২৩ সালে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা টাকায় প্রায় ২৬৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) তাদের ব্যাংকগুলোর বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ এবং বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনার পরিমাণ উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থ হঠাৎ কমে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা ২০২২ সালের ৫ কোটি ৫২ লাখ ফ্রাঙ্কের তুলনায় প্রায় ৬৮ শতাংশ কম। এই পতনে ২০২৩ সালে জমার পরিমাণ নেমে আসে গত ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে।
এক বছরের ব্যবধানে বিপুল উল্লম্ফন ঘটেছে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের পাওনার অঙ্কে, যা ২০১৫ সালের পর এই প্রথম পঞ্চম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর আগে ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক জমা ছিল দেশটির ব্যাংকগুলোতে। ২০১৬ সালে জমার অঙ্ক ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্রাঙ্ক, আর ১৯৯৬ সালে মাত্র ৩ কোটি ৮২ লাখ ফ্রাঙ্ক জমা ছিল বাংলাদেশিদের নামে।
বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যক্তিদের সুইস ব্যাংকে অর্থ রাখার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ দেশটির কঠোর গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশে বাধ্য নয় এবং টাকার উৎস সম্পর্কেও তারা জানতে চায় না। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদেশি অর্থের গোপনীয়তা নিয়ে কিছুটা শিথিলতা এসেছে। প্রতিবছর কোন দেশের গ্রাহকরা কত অর্থ সুইস ব্যাংকে রেখেছেন, তার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন। এই তথ্য প্রকাশ করা হয় দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের আওতায়, তবে এতে ব্যক্তিগত গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশ করা হয় না।
তবে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে জমা থাকা সব অর্থ যে পাচারকৃত, তা নয়—এমন মত অনেকের। তাদের মতে, বাণিজ্যিক লেনদেনের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিভিন্ন কারণে এসব অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা রাখতে পারেন। তবে এই ব্যাখ্যের সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্যে স্পষ্ট করা হয়েছে—এই অর্থ বাংলাদেশি ব্যাংক থেকেই সরাসরি সুইস ব্যাংকে স্থানান্তরিত হয়েছে, এবং এতে ব্যক্তিগত নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টের সংখ্যাই বেশি।
এখন প্রশ্ন উঠছে, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের অর্থ বাড়ার পেছনে কি বাণিজ্যিক কোনো কারণ আছে? কারণ, সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশের বড় কোনো বাণিজ্যিক অংশীদার নয় এবং দুই দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যবসাও নেই। এই প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে সুইস ব্যাংকে জমা হওয়ার পেছনে বাণিজ্যিক কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। যদি এটি ব্যবসার মাধ্যমে না হয়ে থাকে, তবে একে নির্দ্বিধায় ‘ক্যাপিটাল ফ্লাইট’ বা অর্থ পাচার বলা যায়। তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, এই টাকা যদি ‘ব্যাংক টু ব্যাংক’ মাধ্যমে পাঠানো হয়ে থাকে, তবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়েই কি হয়েছে? তার মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে এত বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাঠানো হলে সেটি অনুমোদন ছাড়া সম্ভব নয়।
এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুইস ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের ব্যাংকের বিপুল পরিমাণ পাওনার পাশাপাশি বাংলাদেশি আমানতকারীদের জমা অর্থের পরিমাণ ২০২৪ সালে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক, যা আগের বছর ছিল ১ কোটি ৩৯ লাখ ফ্রাঙ্ক। এছাড়া পুঁজিবাজারে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশের বিনিয়োগ রয়েছে ৮৬ লাখ ১৯ হাজার ফ্রাঙ্ক, যা ২০২৩ সালে ছিল ৮৬ লাখ ৭২ হাজার ফ্রাঙ্ক।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো অর্থের পরিমাণ ১০ কোটি ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর ছিল এটি। ওই সময় জমার পরিমাণ ৯ কোটি ৭২ লাখ ফ্রাঙ্ক থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে। পরের বছর, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে, এই অঙ্ক প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়ে পৌঁছায় ২৪ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঙ্কে।
টাকা পাচারের মাধ্যম : সাম্প্রতিক সময়ে দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। মূলত কয়েকটি মাধ্যমে টাকা পাচার হয়। এরমধ্যে রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ভয়েসিং), হুন্ডি এবং ভিওআইপি ব্যবসা। এছাড়া বড় বড় ঘুস লেনদেন হয় দেশের বাইরে ডলারে, যা পাচারকৃত টাকারই অংশ। গত কয়েক বছরে সরাসরি বিদেশে লাগেজ ভর্তি করে ডলার নিয়ে যাওয়ার তথ্যও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
পাচারের অর্থ ফেরানোর উদ্যোগ : দেশের আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়নে শ্বেতপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যকে প্রধান করে গঠিত কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা গত ৫ বছরে দেওয়া দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের অর্থ দিয়েই ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
সুইস ব্যাংক : সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) হলো সুইজারল্যান্ড সরকারের স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশটির রাজধানী বার্ন শহরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি বিশেষ আইন দ্বারা পরিচালিত। এর নীতিনির্ধারণ সবই স্বাধীন। ২০০ বছরের পুরোনো ইউরোপের এ প্রতিষ্ঠানটি মুদ্রা পাচারকারীদের নিরাপদ স্বর্গ। ব্যাংকটির মুদ্রানীতি এবং সুশৃঙ্খল কার্যক্রম বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অনুসরণ করে। তবে পাচারকারীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে আন্তর্জাতিক মহলে দেশটির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে ২০০২ সাল থেকে দেশভিত্তিক আমানতের তথ্য প্রচার শুরু করেছে ব্যাংকটি। কিন্তু আমানতকারীদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছে না। তবে যেসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি রয়েছে, সেসব দেশের ব্যক্তিগত পর্যায়ে তথ্য দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, তারা কয়েক দফায় সুইস ব্যাংকে চিঠি দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংকের কোনো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়নি।