** দেশে সিরিশ কাগজের বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ৪০০০-৪৫০০ মেট্রিক টন
** দেশে গ্রাউন্ড টেকের বার্ষিক ৪ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে
** আমদানি শুল্ক কম দেখিয়ে শুল্ককর ফাঁকি ও অন্য মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে
** দেশীয় শিল্প বাঁচাতে বাজেটে আমদানি শুল্ক ৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব
দেশে বছরে ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন সিরিশ কাগজের চাহিদা। এর বাজার মূল্য ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। সিরিশ কাগজ শতভাগ আমদানিনির্ভর হলে বর্তমানে দেশেই এ কাগজ তৈরি হচ্ছে। শেলটেক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান গ্রাইন্ড টেক লিমিটেড বিভিন্ন গ্রেডের সিরিশ কাগজ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। কিছু অসাধু আমদানিকারক মিথ্যা ঘোষণা ও কম মূল্য দেখিয়ে সিরিশ কাগজ আমদানি করছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা চলে যাচ্ছে। সিরিশ কাগজ আমদানিতে ট্যারিফ ভ্যালু বা সর্বনিম্ন শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারিত নেই। যার ফলে আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যেই শুল্কায়ন করতে হয়। প্রতি কেজি সিরিশ কাগজ ১ থেকে ২ ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। অথচ সিরিশ কাগজ উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের মূল্য সিরিশ কাগজের ঘোষিত মূল্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি। দেশীয় কোম্পানি গ্রাইন্ড টেক দেশে সিরিশ কাগজের চাহিদার জোগান দিতে রপ্তানি করতে সক্ষম। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম এ শিল্পকে বাঁচাতে সিরিশ কাগজের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। অপরদিকে, সিরিশ কাগজের আমদানি শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে গ্রাইন্ড টেক।
সূত্রমতে, বিশ্বজুড়ে সিরিশ কাগজের বাজারে রাজত্ব করছে জার্মানি। বাংলাদেশে অবশ্য ৭০ শতাংশ সিরিশ কাগজ আসে চীন থেকে। বাকিটা জার্মানি ও সিঙ্গাপুর থেকে। দেশে বছরে ২৫০ কোটি টাকার সিরিশ কাগজ আমদানি করা হয়। আর প্রতি বছর বাজারে প্রায় ২৫ শতাংশ হারে চাহিদা বাড়ছে। দেশে সিরিশ কাগজের চাহিদা মেটাতে শেলটেক গ্রুপের গ্রাইন্ড টেক ২০২১ সালে সিলেটে কারখানা চালু করে। স্থানীয়ভাবে স্যান্ড পেপার বা সিরিশ কাগজ উৎপাদনকারী শিল্পকে শুল্ক সহায়তা দিতে এবং আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ককর বাড়াতে এনবিআরকে প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সম্প্রতি দেয়া এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রাইন্ড টেক দেশে প্রথম ও একমাত্র সিরিশ কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে কয়েকটি দেশ সিরিশ কাগজ উৎপাদন করে থাকে। দেশের চাহিদা বিবেচনায় এ প্রতিষ্ঠান সিলেটের জৈন্তায় কারখানা স্থাপন রেছে। ২০২১ সালের অক্টোবরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করে নভেম্বরে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে। এ শিল্প সুরক্ষায় নীতি সহায়তা দিতে ট্যারিফ কমিশনে আবেদন করা হয়েছে। কমিশন স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিরিশ কাগজের উৎপাদন, আমদানি, চাহিদা, আমদানিতে শুল্কহার, উৎপাদনে ব্যবহার্য কাঁচামাল, কাঁচামালের শুল্কহার, শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ও স্থানীয় বাজার মূল্য পর্যালোচনা করেছে। দেখা গেছে, দেশে বার্ষিক ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিক টন বিভিন্ন স্যান্ড পেপার বা সিরিশ কাগজের চাহিদা রয়েছে; যা আমদানির মাধ্যমে পূরণ হয়। গ্রাইন্ড টেকে উৎপাদিত সিরিশ কাগজ দিয়ে দেশে এই কাগজের চাহিদা জোগান দেয়া সম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে তিন ধরনের সিরিশ কাগজ আমদানি করা হয়। আমদানিতে মোট শুল্ককর ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে কাস্টমস ডিউটি ১০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ, আগাম কর ৫ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৪ হাজার ১৬ মেট্রিক টন সিরিশ কাগজ আমদানি হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৬৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ অর্থবছর ৩ হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ৫২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা; ২০২১-২২ অর্থবছর ৪ হাজার ১৪১ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ৭২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিরিশ কাগজের কাঁচামাল আমদানিতে প্রযোজ্য শুল্ককর ৩১ থেকে ৪৯ শতাংশ। এর কাঁচামাল ভেদে আমদানি শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ৫ শতাংশ ও আগাম কর ৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫ শতাংশ দিতে হয়।
সিরিশ কাগজ আমদানিকে কোনো প্রকার ট্যারিফ ভ্যালু বা সর্বনিম্ন শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারিত নেই উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যারিফ ভ্যালু না থাকায় আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যই শুল্কায়নযোগ্য মূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ৬ মাসের আমদানির তথ্য যাচাইয়ে দেখা গেছে, কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেদের ব্যবহারের জন্য ও কিছু প্রতিষ্ঠান বাজারজাত করার জন্য সিরিশ কাগজ আমদানি করেছে। দুই আমদানিকারকের শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের মধ্যে পার্থক্য দেখা গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি সিরিশ কাগজ ১ থেকে ২ ডলারের শুল্কায়ন করা হয়েছে। বাজার যাচাইয়ে দেখা গেছে, প্রতি শিট সিরিশ কাগজ ১৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজিতে ৪০ থেকে ৫০টি শিট থাকে। প্রতিটির গড় মূল্য ২০ টাকা হিসেবে প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৯০০ টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি সিরিশ কাগজের আমদানি শুল্ক ৫ ডলারের বেশি হওয়া উচিত। এতে প্রমাণিত হয়, আমদানিকারকরা কম মূল্যে শুল্কায়ন করছেন। শুল্কায়নবহির্ভূত মূল্য অন্য কোন মাধ্যমে পরিশোধ করছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানি বাজার প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাচ্ছে। দেশে যেহেতু একটিমাত্র কোম্পানি সিরিশ কাগজ উৎপাদন করছে, সেহেতু এই শিল্পকে শিশুশিল্প হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সুরক্ষা দিলে শিল্পটি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হবে বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন। সেজন্য সিরিশ কাগজের আমদানি শুল্ক বাড়ানো ও উৎপাদনে ব্যবহƒত কাঁচামালের শুল্ক কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
অপরদিকে, আগামী বাজেটে সিরিশ কাগজের আমদানি শুল্ক ৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছে দেশে সিরিশ কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্রাইন্ড টেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল হাসান রিকু সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, শেলটেক গ্রুপের গ্রাইন্ড টেক দেশের প্রথম কোটেড অ্যাব্রেসিভ বা সিরিশ কাগজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। শতভাগ আমদানি বিকল্প শিল্প হিসেবে স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন গ্রেডের সিরিশ কাগজ সরবরাহ করা হচ্ছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও নীতি সহায়তার অভাবে দেশের চাহিদা অনুযায়ী সিরিশ কাগজ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মেশিনের সাহায্যে সিরিশ কাগজ উৎপাদন করা হচ্ছে। দেশে প্রায় ২২০ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকার সিরিশ কাগজের চাহিদা রয়েছে। নীতি সহায়তা দেয়া হলে এ চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি করা সম্ভব। সিরিশ কাগজ আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, সিরিশ কাগজ আমদানিতে হুন্ডির মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা হয়। আমদানি আর মিথ্যা ঘোষণার ফলে একদিকে দেশ থেকে ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে শুল্ককর ফাঁকি হচ্ছে।
আরও বলা হয়েছে, বিশ্বে এই শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হাতেগোনা। গত দুই বছরে কাঁচামালের দাম ৭০ থেকে ১২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে সিরিশ কাগজের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। কিন্তু দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব নেই। কারণ অসাধু আমদানিকারকরা মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে এ কাগজ আমদানি করছেন। আবার সিরিশ কাগজ শুল্কায়ন হচ্ছে ৪০ সেন্ট থেকে দেড় ডলারে। অথচ আমাদের আমদানি করা কাঁচামালের মূল্যে সিরিশ কাগজের শুল্কায়ন মূল্যের চেয়ে তিনগুণ বেশি। এর অর্থ হলো, মিথ্যা ঘোষণা বা কম মূল্য দেখিয়ে সিরিশ কাগজ আমদানি হচ্ছে। আর মূল্য বেশি হলেও সেই টাকা অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে আমদানি করা সিরিশ কাগজের ট্যারিফ মূল্য বেঁধে দেয়া এবং আমদানি শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। এতে স্থানীয় শিল্পটি সুরক্ষা পাবে।