সিন্ডিকেটের কবলে চাল আমদানি

শুল্ক প্রত্যাহার এবং ব্যাংক মার্জিন কমানোর মতো বিভিন্ন পদক্ষেপের পরও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি বৃদ্ধি পায়নি। ফলে, আমদানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য চাল আমদানির এবং বাজারজাতকরণের সময়সীমা আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় ৫ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে, সময়সীমা বৃদ্ধির পরও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির গতি তেমন বাড়েনি, এবং আমদানিকারকরা আগের মতোই এতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজির ফাঁদে পড়েছে চাল আমদানি। এ চক্র নানা অজুহাতে আমদানির লাগাম টেনে ধরে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা লুফে নেওয়ার টার্গেটে রয়েছে। প্রভাবশালী এই চাল সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য না পেলেও ভরা মৌসুমে ঠিকই চালের বাজার চড়ছে।

এদিকে, বেসরকারি আমদানিকারকদের দাবি, ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনমাফিক এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছে না তারা। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশে চালের দাম কম থাকায় অনুমোদন নিয়েও অনেকে আমদানি করেনি। তবে, সম্প্রতি বিশ^বাজারে দাম কমতে থাকায় এবং দেশীয় চালের দামের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় আমদানিকারকদের চাল আমদানিতে এখন আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে। তাই আমদানির জন্য বরাদ্দপ্রাপ্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে এলসি খুলছে।

তবে, চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাল আমদানির জন্য নতুন করে যেসব এলসি (ঋণপত্র) খোলা হচ্ছে তা আমদানি করে বাজারজাত করতে অনেকটা সময় লাগবে। তাই ওই চালানের চালের জোগানে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এর আগেই বাজার অস্বাভাবিকভাবে চড়বে। আর এ টার্গেট নিয়েই বাজার সিন্ডিকেট চাল আমদানির কারসাজির ফাঁদ পেতেছে।

খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় তিন মাসে ১৩ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। তবে, এতে দেশের বাজারে দাম না কমে উল্টো কেজিপ্রতি ২/৩ টাকা করে বেড়েছে। এ অবস্থায় ভারত থেকে চাল আমদানির সময়সীমা আবারও বাড়ানো হয়। আমদানির জন্য বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত ভারত থেকে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়।

এদিকে, বাজার সংশ্লিষ্টদের দাবি, দেশে বর্তমানে ধান-চালের কোনো সংকট নেই। মাস দেড়েক আগে কৃষকের ঘরে উঠেছে আমন ধান। তারপরও সাধারণ মানুষকে বেশি দামেই চাল কিনতে হচ্ছে। এতে অনেকে আর্থিক সংকটে পড়েছেন। কম দামে চাল না কিনতে পেরে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ। সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় দাম কমছে না বলে মনে করছেন তারা। বিশেষ করে বাজার নিয়ন্ত্রণে নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় দাম বাড়ছে বলে জানান তাদের অভিযোগ।

চাল ব্যবসায়ীরাও বিষয়টি স্বীকার করে বলছেন, চালের দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, খেটে খাওয়া মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বর্তমানে জিনিসপত্রের দাম বেশি হওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষকে খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন নিত্যপণ্যসহ বাড়ছে চালের দাম। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি।

আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর গত বছরের ১৭ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি তিন মাসে বেনাপোল দিয়ে ১৩ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার গত ১৭ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমোদন দেয়। এ সময়ের মধ্যে আশানুরূপ আমদানি না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। তাতেও দেশের বাজারে চালের দাম না কমায় ভারত থেকে আমদানির জন্য আগামী ১৫ মার্চ পর্যন্ত এক মাস সময় বাড়িয়েছে সরকার। আশা করা যায়, সামনে দাম কমবে। আমদানিকারকদের ভাষ্যমতে, ভারতে চালের দাম বেশি। এ কারণে আমদানিকৃত চাল কম দামে বাজারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে, চলতি মৌসুমে ধানের দাম বেশি, যে কারণে কমছে না চালের দাম এমনটাই বলছেন অটোরাইস মিল মালিক ও ধান ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, নতুন ধানের চাল বাজারে আসতে শুরু করেছে। আমদানিও স্বাভাবিক রয়েছে। যদিও এবার অতিবৃষ্টির কারণে উৎপাদন কমেছে। সে কারণে আমদানি চলমান থাকলে দাম কিছুটা বাড়বে। চাল আমদানির কারসাজিতে বিশেষ কোনো সিন্ডিকেট জড়িত থাকলেও তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন অটোরাইস মিল মালিকরা।

বেশ কিছু রাইস মিল মালিকের দাবি, দাম বাড়ানোর আশায় কৃষকরা ধান মজুত রেখেছেন, যার ফলে বাজারে ধানের সরবরাহ কমে গেছে এবং দাম বেড়ে গেছে। এই কারণে, তাদের ধান কেনার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হচ্ছে। ধান সরবরাহের ঘাটতির কারণে চালের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে, এমনটা তাদের ধারণা। বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কার্গো শাখার রাজস্ব কর্মকর্তা আবু তাহের জানান, গত ১৭ নভেম্বর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটটি চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মোট ১৩ হাজার ৯৬৮ মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে। সারাদেশে আমদানির জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ৯২টি প্রতিষ্ঠানকে, তাদের জন্য দুই লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন সেদ্ধ এবং এক লাখ ১৯ হাজার মেট্রিক টন আতপ চাল আমদানির অনুমতি ছিল। তবে, অনেক প্রতিষ্ঠান এই সময়ের মধ্যে আমদানি করতে পারেনি। সরকার আমদানি করা চাল বাজারে বিক্রি করার জন্য ২৫ দিনের সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল, যা পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে, আমদানির গতি ধীর হওয়ায়, প্রয়োজনীয় পরিমাণ আমদানি না হওয়ায়, সরকার আরও এক মাস সময় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকট সমাধানে সরকার চাল আমদানির গুরুত্ব দিলেও, চালের দাম দ্রুত কমার সম্ভাবনা নেই। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির পরেও এক মাসের ব্যবধানে দেশীয় চালের দাম ৫০ কেজির বস্তায় ২০০ টাকা বেড়ে গেছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজার সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতি বস্তা আমদানিকৃত ভারতীয় স্বর্ণা সিদ্ধ চাল ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে, ভারত থেকে আমদানি হওয়া আতপ পাইজাম ১ হাজার ৪০০ টাকা (২৫ কেজি) এবং সিদ্ধ কাটারি ২৫ কেজির বস্তা ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইল সিদ্ধ চালের ২৫ কেজির বস্তা ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গুণগত মানের দিক থেকে দেশীয় চাল ভারতীয় চালের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও, দেশীয় চালের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে, দেশীয় চালের বিক্রি বেশি বলে জানান আড়ত ও কমিশন এজেন্ট ব্যবসায়ীরা।

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতীয় চালের তুলনায় একই মানের দেশীয় চাল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। যেমন, ভারত থেকে আমদানি হওয়া স্বর্ণা সিদ্ধ ২ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হলেও, দেশীয় স্বর্ণা সিদ্ধ ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাজিরশাইলের দামও ২ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। নতুন জাতের চালের দাম বেশি হলেও ক্রেতাদের চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে প্রান্তিক অঞ্চলে আমদানিকৃত চালের তুলনায় দেশীয় চালের চাহিদা বেশি।

খাদ্য বিভাগ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুত ছিল ১৫ লাখ ৯ হাজার ৬৪৭ টন, যার মধ্যে চালের মজুত ছিল ১০ লাখ ৮৪ হাজার ৮০৪ টন। তবে, বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিতে ধীরগতি এবং বাজারে চাল সংকটের অজুহাতে দাম বৃদ্ধির জন্য মিলমালিক ও বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট দায়ী হতে পারে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, কৃষকের কাছ থেকে ৩৩ টাকা কেজি দরে কেনা ধান বাজারে ৬৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এই বিশাল পার্থক্য শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নয়, বরং বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের অভাবও এর জন্য দায়ী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও কারসাজির শিকার, ফলে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে চাল পাচ্ছেন না এবং কৃষকরাও ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ যথেষ্ট না হওয়ায়, ধান উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠতে পারে।

এ অবস্থায়, চালের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে সরকারের আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। শুধু আমদানি বাড়িয়ে সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়, বরং বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায়, চালের দাম আরও বাড়তে পারে, যা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!