সিটি গ্রুপের ২৬ কোটি টাকা শুল্ককর ফাঁকি

কাস্টমস গোয়েন্দার প্রতিবেদন

** প্রজ্ঞাপনের শর্ত ভঙ্গ করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রাইম হট রোল্ড প্লেট আমদানির মাধ্যমে এ শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়
** নিয়মবহির্ভূতভাবে দুটি চালানে ৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৬ টাকার প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং বানানোর ম্যাটেরিয়াল আমদানি
** দুইটি চালানে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২৪ টাকা

দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারি করা প্রজ্ঞাপনের শর্ত ভঙ্গ করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রাইম হট রোল্ড প্লেট আমদানির মাধ্যমে এ শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের তদন্তে শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে ফাঁকি দেয়া রাজস্ব আদায়ে এবং সিপিসি কোড ব্যবহারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি সুবিধার অপব্যবহার করে অন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করছে বলে গোপন সংবাদে জানা গেছে। এনবিআরের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বেজার আওতায় প্রতিষ্ঠানকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল আমদানি করতে পারে। তবে এজন্য বেজা থেকে আমদানি পারমিট (আইপি) নিতে হয়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞাপনের শর্ত পূরণ না করে পণ্য খালাসের সময় সিপিসি (কাস্টমস প্রসিডিউর কোড) ব্যবহার করে ভুল শুল্কায়ন করছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের উত্তর রূপসীতে প্রায় ১০০ একর জমিতে সিটি ইকোনমিক জোন গড়ে তুলেছে সিটি গ্রুপ। এ জোনে সিটি অটো রাইস ও ডাল মিলস, সিটি এডিবল অয়েল, রূপসী সুগার মিল, রূপসী ফ্লাওয়ার মিল, রূপসী ফিড মিল ও সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে সিটি অটো রাইস অ্যান্ড ডাল মিলস ও সিটি এডিবল অয়েল ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে রয়েছে। একই বছরের ডিসেম্বর থেকে সিটি সিড ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ বাণিজ্যিক উৎপাদনে রয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণে প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং বানাতে প্রতিষ্ঠানটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্রাইম হট রোলড প্লেট আমদানি করে। অথচ ২০১৫ সালের এনবিআরের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সহজলভ্য নির্মাণসামগ্রী যেমন এমএস রড/বার, সিমেন্ট, প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং, আয়রন, স্টিল সিট আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।এমনকি অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন ও নির্মাণে সরাসরি সম্পৃক্ত নয় এমন পণ্য (অফিস সরঞ্জামাদি, এয়ারকন্ডিশন, রেফ্রিজারেটর, গৃহস্থালির ব্যবহার্য দ্রব্যাদি, খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় এবং অন্য ভোগ্যপণ্য) আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে না।

অনুসন্ধানে কাস্টমস গোয়েন্দা দেখতে পায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে সিটি গ্রুপ প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিং বানানোর ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে কাস্টমসে বেজার নির্ধারিত সিপিসি কোড ব্যবহার করে শুল্ক ছাড়াই দুটি চালানে ৬৮ কোটি ৮৪ লাখ ৪৩ হাজার ৭৬ টাকার পণ্য খালাস করেছে। এতে সরকার ২৬ কোটি ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২৪ টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।

City Economic Zone 1
এ বিষয়ে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ বিজনেস বার্তাকে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা তাদের আপত্তির বিষয় জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসকে চিঠি দিয়েছে। আমরা চিঠির উত্তর দিয়েছি। শুনানির পর শুল্ক গোয়েন্দার প্রতিবেদনের যথার্থতা নিরূপণ হবে।

অবশ্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্ধ্বতন কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিজনেস বার্তাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃতভাবে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে। প্রজ্ঞাপনে যেখানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, প্রি-ফেব্রিকেটেড বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে এসআরও সুবিধা প্রযোজ্য হবে না, সেখানে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পণ্য খালাসে সিপিসি কোড ব্যবহার করেছে। শুধু সিটি গ্রুপই নয়, আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এ ধরনের শুল্ক ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বিজনেস বার্তাকে বলেন, প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক পরিশোধ করতে চূড়ান্ত নোটিশ পাঠানো হয়েছে। পাওনা আদায়ে কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সম্ভবত বেজার আইপিতে অস্পষ্টতা ছিল। তাই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এভাবে পণ্যের খালাস দিয়েছেন। অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর সুবিধার অপব্যবহার বিষয়ে ১৬ জুলাই এনবিআরে জরুরি সভা হয়। এতে এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, আইন অনুযায়ী অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প গড়ে তোলা হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অগ্রিম আয়কর (এআইটি), আগাম কর (এটি) ও আয়কর অব্যাহতি পায়। আর এ সুবিধা নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলভুক্ত দুটি প্রতিষ্ঠান ভোজ্য তেল, চিনি, আটা, ময়দা স্থানীয় বাজারে কম দামে সরবরাহ করছে। অথচ অর্থনৈতিক অঞ্চলের বাইরে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী অন্য কোম্পানিগুলোকে সব ধরনের কর পরিশোধ করতে হয়। তাই তাদের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বেশি পড়ে। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

বেজার ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে যোগাযোগ করে জানা গেছে, বেজার থেকে সিটি গ্রুপকে আমদানি পারমিটে (আইপি) বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালের যেসব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়া নেই, সেগুলোকে ‘আদার্স বা অন্যান্য’ সামগ্রীর তালিকায় দেয়া হয়। কিন্তু খালাসের সময় কাস্টমস সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই না করায় জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, কাস্টমস যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন না করায় এ ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। এখানে বেজার ভুল নেই। বেজা থেকে দেয়া আইপিতে পণ্যের ধরন উল্লেখ করা ছিল।

** সিটি সুগারের ২৮০ কোটি টাকার শুল্ককর ফাঁকি
** ‘সিটি সুগারের’ বন্ড সুবিধার অপব্যবহার থামছে না

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!