সিঙ্গাপুরে কোম্পানি খুলে ১৯৪ কোটি টাকা পাচার

বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে তিনি সিঙ্গাপুরে কোম্পানি খুলেছেন। সেই কোম্পানি থেকে আমদানি দেখিয়ে পাচার করা হয় ১৯৪ কোটি টাকা। এই ব্যক্তির নাম রাইয়ান কবির। তিনি সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের ছেলে। দেশবন্ধু গ্রুপ ও জারা জামান টেকনোলজির নামে এলসি খুলে এ অর্থ বিদেশে নেওয়া হয়। অর্থ পাচারের পাশাপাশি আলমগীর কবিরের বেয়াইয়ের প্রতিষ্ঠানের ঋণ স্থিতির তুলনায় ১৩ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ দিয়ে আত্মসাৎ, ১০ টাকার শেয়ার ২৫ টাকায় কেনাসহ নানা জালিয়াতির তথ্যও পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, আলমগীর কবিরের ছেলে রাইয়ান কবির এবং তাঁর পুত্রবধূ নুসরাত নাহারের নামে ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে ‘আর অ্যান্ড এন হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেড’ কোম্পানি খোলা হয়। কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১৪ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার। দেশ থেকে বৈধ উপায়ে এ অর্থ নেওয়া হয়নি। অথচ ব্যাংক ওই কোম্পানির অনুকূলে বিপুল অঙ্কের এলসি খুলেছে। এর মধ্যে ১৭টি এলসির বিপরীতে এক কোটি ৫৯ লাখ ১১ হাজার ৫৮৪ ডলার পাচার হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিএফআইইউ। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যার পরিমাণ ১৯৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত বৈধ পন্থায় ২৬টি গ্রুপের ৩৫টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। সেই তালিকায় রাইয়ান কবিরের প্রতিষ্ঠানটি নেই।

বিএফআইইউর পরিদর্শনে এসব এলসির বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল সময়ে ১৭টি এলসি খোলা হয়। এর মধ্যে ১৪টিই ছিল দেশবন্ধু গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানের সিমেন্টের ক্লিংকার ও মূলধনি যন্ত্রপাতি। এলসির বিপরীতে দেশে পণ্য আসেনি। এ প্রক্রিয়ায় পাচার হয়েছে এক কোটি ৪৮ লাখ ৫৩ হাজার ৩৮৫ ডলার। বাকি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ১৯৯ ডলার সিঙ্গাপুরে পাচার হয়েছে জারা জামান টেকনোলজির নামে। আলমগীর কবির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় দেশবন্ধু গ্রুপ ও জারা জামান ব্যাংকটির বিশেষ আনুকূল্য পেয়েছেন। ব্যাংকের বেশির ভাগ এটিএম বুথ আনা হয় জারা জামান টেকনোলজির মাধ্যমে।

ব্যাংকটিতে দেশবন্ধু গ্রুপের বর্তমানে ঋণ রয়েছে এক হাজার ১৬২ কোটি টাকা। যার পুরোটাই বেশ আগেই খেলাপি। তবে আলমগীর কবির চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় এসব ঋণ খেলাপি দেখানো যায়নি। ২০০৪ সাল থেকে টানা ২০ বছর ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের পদ আঁকড়ে ছিলেন আলমগীর কবির। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি প্রথমে চেয়ারম্যানের পদ হারান। চলতি বছরের জুলাইতে পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেন। আলমগীর কবির চেয়ারম্যানের পদ হারানোর পর খেলাপি হয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। এই ঋণ খেলাপি না দেখাতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ পেয়েছে গ্রুপটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশবন্ধু সুগার মিলের মূলধনি যন্ত্রপাতির নামে ২০১৬ সালের অক্টোবরে ৫৫ লাখ ডলারের একটি এলসি খোলা হয়। আলমগীর কবিরের ছেলের সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানির মূল্য এখনও পায়নি ব্যাংক। বাকি ১৩টি এলসি করা হয় দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলসের নামে। ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ক্লিংকার আমদানি দেখানো হয়। জারা জামান টেকনোলজি সিঙ্গাপুরের আর অ্যান্ড এন ট্রেড হোল্ডিংস থেকে চারটি এলসির বিপরীতে পাঁচ লাখ এক হাজার ডলারের এটিএম আমদানি দেখায়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের জুলাইতে খোলা হয় এক লাখ ২৫ হাজার ডলারের এলসি। আর ২০১৬ সালের জুলাইতে ৭৮ হাজার ডলার, ২০১৮ সালের জুনে ৮৮ হাজার ডলার এবং ওই বছরের সেপ্টেম্বরে খোলা দুই লাখ ১০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। সর্বশেষ তিনটি এলসির বিপরীতে পাচার হয়েছে মনে করছে বিএফআইইউ।

অনিয়মের অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে আলমগীর কবিরের কাছে টেলিফোনে বক্তব্য চাওয়া হয়। তিনি এসব প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, ‘জীবনে কখনও কোনো অন্যায়, তহবিল তছরুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হইনি। আমাকে বেইজ্জতি করার জন্য এসব রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।’ রাইয়ান কবিরকে টেলিফোনে পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তায় সাড়া দেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ব্যাংকটির জবাব দেওয়ার জন্য নির্ধারিত সময় এখনও পার হয়নি। তাদের জবাব পাওয়ার পর সন্তোষজনক না হলে বিধিমোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দু’এক দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠির জবাব দেওয়া হবে। আর কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অডিট করানোর কথা বলেছে। সে জন্য কিছু ক্ষেত্রে সময় চাওয়া হবে।

ছেলেকে পরিচালক করতে শেয়ার ক্রয়

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, আলমগীর কবির চেয়ারম্যান থাকাকালে তাঁর ছেলেকে ব্যাংকটির পরিচালক বানানোর জন্য ১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকার শেয়ার কেনা হয়। এই শেয়ার কিনতে এক টাকাও রাইয়ান কবির দেননি। বরং জালিয়াতির মাধ্যমে বিএলআই ক্যাপিটাল সিকিউরিটিজ কোম্পানির অনুকূলে ঋণ দেয় ব্যাংকটি। সেই টাকার পে-অর্ডার ইস্যু করে তা দিয়ে রাইয়ান কবিরের নামে শেয়ার কেনে ব্যাংক।

জানা গেছে, রাইয়ান কবির ২০০৩ সালে সাউথইস্ট ব্যাংকে ট্রেজারি বিভাগে চাকরি করতেন। তথ্য গোপন করে ২০২১ সালে ব্যাংকের টাকায় কেনা শেয়ারের বিপরীতে পরিচালক নিযুক্ত হন তিনি। তথ্য গোপন করে পরিচালক হওয়ার সত্যতা পাওয়ায় ২০২২ সালের মে মাসে রাইয়ানকে বরখাস্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেয়াইয়ের প্রতিষ্ঠানে ঋণের চেয়ে বেশি সুদ মওকুফ!

আলমগীর কবিরের ছেলের শ্বশুরের প্রতিষ্ঠান লুব রেফ বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি আইপিওতে শেয়ার বিক্রির অনুমোদন পায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০২১ সালের মার্চে। সাউথইস্ট ব্যাংক ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান মিলে লুব রেফ তালিকাভুক্ত হওয়ার আগেই এক কোটি ৩৪ লাখ প্রি-আইপিও প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনে। এ উপায়ে দশ টাকা অভিহিত মূল্যের প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা দরে কেনা হয়। সব মিলিয়ে ব্যাংককে মোট ৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার শেয়ার কিনতে বাধ্য করা হয়।

লুব রেফ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান অভিহিত মূল্যের তুলনায় বেশি দরে এ প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত হয়। লুব রেফকে লাভজনক দেখাতে ঋণস্থিতির তুলনায় বেশি সুদ মওকুফ করে ব্যাংকটি। তালিকাভুক্তির আগে ২০২০ সালের অক্টোবার ব্যাংকে সুদসহ লব রেফের ঋণস্থিতি ছিল ৪২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অথচ সুদ মওকুফ করা হয় ৫৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ঋণস্থিতির অতিরিক্ত ১৩ কোটি টাকা ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির চলতি হিসাবে স্থানান্তর করে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়া হয়। আর এভাবে তালিকাভুক্ত হওয়ার বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট মুনাফা দেখানো হয় ৩৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লুব রেফের ঋণস্থিতির মধ্যে আসল ছিল ৩১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী ঋণের আসল মওকুফের কোনো সুযোগ ব্যাংকের নেই। আবার ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকের পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা পরিবারের সদস্য কোনোভাবে নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হয় এমন প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফ করতে পারে না। সাধারণভাবে পে-অর্ডারের স্থিতির বিপরীতে কোনো সুদ দেওয়া হয় না। অথচ নজিরবিহীনভাবে লুব রেফের পে-অর্ডারের স্থিতির ওপর ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকা সুদ দেয় ব্যাংক। বিনিয়োগ কমিটিকে পাশ কাটিয়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবির এবং এমডি এম কামাল হোসেনের মৌখিক নির্দেশে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই এই বিনিয়োগ করা হয়। বিডি থাই ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রি-আইপিও শেয়ার কেনার সময় ও টাকা প্রিমিয়াম হিসেবে দেওয়া এক কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যাংকের ‘প্রমোশনাল ব্যয়’ হিসেবে বিকলন করা হয় যা সন্দেহজনক। প্রি-আইপি প্লেসমেন্টের প্রিমিয়াম হিসেবে দেওয়া অর্থ শেয়ার মানি ডিপোজিট হিসাবে জমা না করে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

জালিয়াতি করে বে লিজিংকে ২০০ কোটি টাকা

ব্যাংকের জন্য ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ফায়ারওয়াল, লোকাল ট্রাফিক ম্যানেজার এবং ডিএনএস গার্ড নামের সফটওয়‍্যার কেনার ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরস্পরের যোগসাজশে বিপুল অর্থ বের করা হয়েছে। ব্যাংকে ক্রয়সংক্রান্ত একটি কমিটি রয়েছে। এই কেনাকাটার ক্ষেত্রে দর অস্বাভাবিক বেশি হওয়া এবং দুর্নীতির আশঙ্কায় কমিটির তৎকালীন সদস্যরা অফিস নোটে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকেন। পরে ২০২১ সালের ৭জুন ‘পারচেজ অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোল’ নামে নতুন কমিটি করে তাদের সুপারিশে পর্যদ স্মারক উপস্থাপন করে তা অনুমোদন করিয়ে নেয়।

বিএফআইইউর পরিদর্শনে আরও উঠে এসেছে, সাউথইস্ট ব্যাংক ২০২১ সালে বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টে ১৪৬ কোটি ৫০ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত রাখে। দুর্দশাগ্রস্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায় করতে পারেনি ব্যাংক। অথচ কলমানি হিসেবে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আরও ৫৪ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয় যা সন্দেহজনক। ব্যাংকটির ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা না করে সাবেক চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অপর প্রতিষ্ঠান বে লিজিংয়ে অর্থ স্থানান্তর করেছেন। বে লিজিংয়ের চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের স্ত্রী সুরাইয়া বেগম।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ঋণ জালিয়াতি, বিনিয়োগের আড়ালে স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর, বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে আলমগীর কবির, তাঁর পুত্র রাইহান কবির এবং পুত্রবধূ নুসরাত নাহারসহ ব্যাংকের তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা, ক্রেডিট কমিটি, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ, ট্রেজারি বিভাগ, সিআরএম বিভাগ, সিএফও এবং শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব অনিয়মে সহযোগিতা করেছেন। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যদের এসব তথ্য উত্থাপন করে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে জানাতে ইতোমধ্যে বর্তমান কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের আবেদনে আলমগীর কবির এবং তাঁর ছেলে রাইয়ন কবিরের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। আর গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা পলাতক।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!