সিঅ্যান্ডএফ নেতার ১.৬৭ লাখ ডলারের পণ্য ৪৬ হাজারে শুল্কায়ন!

** আমদানিকারক-সিঅ্যান্ডএফ যোজসাজসে ভুয়া ইনভয়েস বানানো হয়েছে, ইন ভয়েস যাচাই করেনি কাস্টমস
** মূল ইনভয়েস ও রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণসহ এনবিআর চেয়ারম্যানকে অভিযোগ দেওয়া হলেও ব্যবস্থা নেয়নি
** কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের ৪০ লাখ ও কাস্টমস গোয়েন্দাকে ৪৫ লাখ টাকা ঘুস দিয়ে পণ্য খালাস হয়েছে

শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করা হয়েছে চকলেট (কিন্ডার জয়)। দুইটি ইনভয়ের মাধ্যমে আমদানি করা এই চকলেটের মোট আমদানি মূল্য এক লাখ ৬৭ হাজার ২৯২ ডলার। কিন্তু বিল অব এন্ট্রিতে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪৬ হাজার ৮৪১ দশমিক ৭৬ ডলার। অর্থাৎ পণ্যের মূল্য এক লাখ ২০ হাজার ৪৫০ দশমিক ২৪ ডলার গোপন করা হয়েছে। যার উপর শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। তবে বিল অব এন্ট্রির সঙ্গে ভুয়া ইনভয়েস দেওয়া হয়েছে। আর এই শুল্ককর ফাঁকি দিতে প্রায় ৮৫ লাখ টাকা ঘুস দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। আর এই ঘটনার মূল হোতা সিঅ্যান্ডএফ নেতা মো. আলতাফ হোসাইন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের পলাতক এই নেতা তার মালিকানাধীন বিপ্লব ট্রেড ওভারসীজ লাইসেন্সের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ শুল্ককর ফাঁকি দিয়ে ঘুসের বিনিময়ে পণ্য চালানটি খালাস করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাস্টমস ইনভয়েস খতিয়ে দেখে মামলা করলে শুল্ককর ফাঁকিসহ এই চালান থেকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো। মোটা অংকের ঘুস নিয়ে কাস্টমস পলাতক এই নেতাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন তারা। ঘুস লেনদেন ও শুল্ককর ফাঁকির বিষয়ে প্রমাণসহ এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

সূত্রমত্রে, চট্টগ্রামের জুবলী রোডের আমদানিকারক বি অ্যান্ড বি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। আইজিএম’র তথ্যমতে, প্রতিষ্ঠানটি শ্রীলঙ্কার কলম্বো থেকে বিএস কার্গোর মাধ্যমে চকলেট (কিন্ডার জয়) আমদানি করেছে। আর আমদানিকারকের ইনভয়েস বলছে, আমদানিকারক দুবাইয়ের প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসি থেকে পণ্য ক্রয় করলেও শ্রীলঙ্কার দি কর্মাশিয়াল ব্যাংক অব সিলন পিএলসিতে ডলারে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করেছে। তবে পণ্যটির কান্ট্রি অব অরজিন হলো ইন্ডিয়া। দুইটি ইনভয়েসে মোট এক লাখ ৬৭ হাজার ২৯২ ডলারের পণ্য ক্রয় করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় দুই কোটি ৭৫ হাজার ৪০ টাকা (এক ডলার ১২০ টাকা)। এর মধ্যে প্রথম ইনভয়েসে ৮৩ হাজার ৫৯২ ডলার ও দ্বিতীয় ইনভয়েসে ৮৩ হাজার ৭০০ ডলার। ইনভয়েস অনুযায়ী, ২০২৪ সালর ৩ জুলাই চালানটির শিপমেন্ট হয়েছে। তবে বিল অব এন্ট্রিতে আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট তথ্যের ব্যাপক গরমিল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ভুয়া ইনভয়েস দেখিয়ে পণ্য চালান খালাস করেছে।

সূত্র আরও জানায়, ১০ নভেম্বর আমদানিকারকের পক্ষে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি (বিল অব এন্ট্রি নং-২০৮০০৭২) দাখিল করে সিঅ্যান্ডএফ বিপ্লব ট্রেড ওভারসীজ। যার মালিক হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ক্লিয়ারিং এন্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসাইন চৌধুরী বাচ্চু। অভিযোগ রয়েছে, বাচ্চু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রভাব খাটিয়ে শুল্কফাঁকি ও মিথ্যা ঘোষণার পণ্য খালাসের একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাসিনার পতনের পর বর্তমানে তিনি পলাতক রয়েছেন। তবে পলাতক থেকে হাউসে তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণা ও শুল্কফাঁকি দেওয়া পণ্য খালার করে যাচ্ছেন। তাকে কাস্টম হাউসের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সূত্র আরও জানায়, পলাতক থাকলেও ১০ নভেম্বর তার লাইসেন্সে চালানটি খালাসের জন্য বিল অব এন্ট্রি দাখিল হয়েছে। তবে বিল অব এন্ট্রি দাখিলের পর পণ্য খালাস পর্যন্ত চরম এক নাটকী তৈরি হয়। বিল অব এন্ট্রিতেও দেয়া হয় বেশ কিছু মিথ্যা তথ্য। পণ্যের ইনভয়েসে রপ্তানিকারক দুবাইয়ের ‘প্যানমার্ক ইম্পেক্স মেগা ট্রেডিং এলএলসি’ হলেও বিল অব এন্ট্রিতে দেখানো হয় দুবাইয়ের ‘ব্লু আউল জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি’র নাম। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বিল অব এন্ট্রিতে পণ্যের মূল্য দেখিয়েছে মাত্র ৪৬ হাজার ৮৪১ দশমিক ৭৬ ডলার। অর্থাৎ পণ্যের মূল্য এক লাখ ২০ হাজার ৪৫০ দশমিক ২৪ ডলার গোপন করা হয়েছে। যার উপর শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের যোগসাজসে একটি ভুয়া একটি ইনভয়েস তৈরি করে দাখিল করা হয়। তবে কাস্টম হাউসে শুল্কায়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা এই ভুয়া ইনভয়েস যাচাই করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। এই চালানে শুল্ককর ফাঁকির তথ্য পায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও কাস্টমস গোয়েন্দার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। পরে চালানটি লক করা হয়। এরপর থেকে বাচ্চুর গোপন মিশন শুরু হয়।

অভিযোগ উঠেছে, শুল্ককর ফাঁকি থেকে বাঁচতে বাচ্চুর সিন্ডিকেট ও বাচ্চু নিজে কাস্টম হাউস ও কাস্টমস গোয়েন্দার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করা শুরু করেন। কাস্টম হাউসের একাধিক কর্মকর্তাকে প্রায় ৪০ লাখ ও কাস্টমস গোয়েন্দার এক কর্মকর্তাকে ৪৫ লাখ টাকাসহ মোট ৮৫ লাখ টাকা ঘুস দিয়ে চালানটির দফারফা করা হয়। পরে সামান্য মূল্য বৃদ্ধি দেখিয়েছে প্রায় একমাস পর ১৮ ডিসেম্বর চালানটি খালাস করা হয়েছে। অথচ চালানটিতে শুল্ককর ফাঁকি হয়েছে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, কাস্টম হাউস জরিমানা করলে সরকার এই চালান থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারতো প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণা ও শুল্ককর ফাঁকিতে সহায়তার দায়ে সিঅ্যান্ডএফ লাইসেন্সের বিরুদ্ধে কাস্টম হাউস ব্যবস্থা নিতে পারতো। অথচ মোটা অংকের ঘুসের বিনিময়ে সিন্ডিকেটের নেতা বাচ্চুর চালানটি খালাস হয়েছে, সঙ্গে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বাচ্চুর একই লাইসেন্স দিয়ে এর আগেও একাধিক মিথ্যা ঘোষণা, শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া পণ্য খালাস হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপরদিকে, ঘুস লেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া এই চালান খালাস করা হচ্ছে-এমন অভিযোগ এনে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এনবিআরের জিআরএস অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, প্রমাণাদিসহ চেয়ারম্যানের কাছে এই অভিযোগ করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো এই দুর্নীতিবাজ আওয়ামী লীগ নেতা ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর মো. আলতাফ হোসাইন চৌধুরীর পলাতক থেকেও ঘুসের বিনিময়ে চালানটি খালাস করে নিয়ে গেছেন। এই নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস বার্তাকে বলেন, ঘুস নেয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। চালানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ার পর আমরাই লক করেছিলাম। পরে কায়িক পরীক্ষা করেছি। পণ্যের ঘোষিত মূল্য কম ছিলো। ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়ন করা হয়নি। আমরা পণ্যটির বাজারমূল্য যাচাই করে মূল্য বাড়িয়ে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় করেছি। তিনি বলেন, চালানটি নিয়ে এনবিআরে অভিযোগ করা হয়েছে। সিআইসি তদন্ত করেছে, যাতে কোন অনিয়ম পায়নি। আমরা এনবিআরকে বলেছি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার। এরপরও শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ পাচ্ছি।

এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দার সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, কিন্ডার জয় নামে চকলেট আমদানি করেছে। মূলত কিন্ডার জয় মানে চকলেট ও খেলনা একসঙ্গে থাকে। আমরা তথ্য পেয়ে চালানটি লক করেছি। উদ্দেশ্য ছিলো চকলেট আর খেলনা আলাদা আলাদা শুল্কায়ন করা। কিন্তু প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে একটা রুলিং এনেছে যে চকলেট ও খেলনা একসঙ্গে শুল্কায়ন ও খালাস হয়। মূলত খেলনার জন্য বাচ্চারা এই চকলেট কিনে। পরে অভিয়োগ উঠে ইনভয়েস জালিয়াতির। একজন একটা ইনভয়েসসহ অভিযোগ করে। কিন্তু যাচাই করে দেখা যায় অভিযোগের সঙ্গে দেয়া ইনভয়েস ভুয়া। আর চকলেট আমদানি হয়েছে ইন্ডিয়া থেকে, কিন্তু ইনভয়েস দিয়েছে শ্রীলঙ্কার।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নেতা মো. আলতাফ হোসাইন চৌধুরী বাচ্চুর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!